১৯৮৮র আজকের দিনে ক্রিকেটের এক উদাসীন যোদ্ধা জন্মেছিলেন ভারতের মহারাষ্ট্রের আহমেদনগরের অশ্বি-কেডিতে।
এখন আইসিসি টেস্ট রেটিংয়ে ৩০তম স্থানে (২০২১-এর মার্চ মাসেও যা ছিল ১৫তম) দাঁড়িয়ে থাকা এই ক্রিকেটারের রেকর্ড আরো অনেক বেশী আকর্ষণীয় দেখাত, যদি আর একটু মনোযোগী ও বাস্তববাদী হতেন। অথবা আর একটু “ইয়েসম্যান” হবার প্রবণতা দেখালেও। ৯ বছর টেস্ট ম্যাচ (২২/০৩/২০১৩ – ১৪/০১/২০২২), ৭ বছর ওডিআই ম্যাচ (০৩/০৯/২০১১ – ১৬/০২/২০১৮) ও ৫ বছর টি২০ ম্যাচ (৩১/০৮/২০১১ – ২৮/০৮/২০১৬) খেলার পরে ৮২ টেস্টে ১২টি শতক (সর্বোচ্চ ১৮৮) ও ২৫টি অর্ধশতকসহ ৪,৯৩১ রান অথবা ৯০টি ওডিআই ম্যাচে ৩টি শতক (সর্বোচ্চ ১১১) ও ২৪টি অর্ধশতকসহ ২,৯৬২ রান কিংবা ২০টি টি২০ ম্যাচে ১টি অর্ধশতকসহ (সর্বোচ্চ ৬১) ৩৭৫ রান দিয়ে পুরোপুরি মাপা যায়না এই প্রতিভাধর ক্রিকেটারকে। টিমের বিশ্বস্ত ফিল্ডারদের মধ্যেও তাঁকে ধরা হয়। টেস্ট ম্যাচ, ওডিআই ম্যাচ এবং টি২০ ম্যাচেএই বিশ্বস্ত ফিল্ডার যথাক্রমে ৯৯, ৪৮ এবং ১৬টি ক্যাচ তালুবন্দী করেছেন। আইপিএলে ১ ওভারে ৬টি চার মারার কৃতিত্বেরও অধিকারী তিনিই, ২০১২ সালে।
তিনি শেষ টি২০ খেলেছেন ২৮শে আগস্ট ২০১৬ (আর খেলার আশা কম) এবং শেষ ওডিআই ম্যাচ খেলেছেন ১৬ই ফেব্রুয়ারি ২০১৮ (এটিও আর খেলার আশা কম)। একমাত্র টেস্ট ক্রিকেটের জন্যই ভারতীয় দলে তাঁকে ভাবা হয়েছে গত ৬ বছর ধরে। এবং ওই ৬ বছরে তাঁর আপাত-উদাসীনতা ও শান্তভাব এজন্য তাঁর কাছ থেকে সাংবাদিকদের জন্য কোন বিস্ফোরক বাইট উৎপন্ন করেনি। ভারতীয় ক্রিকেট ২০১১ থেকে ২০২০-র মধ্যে অনেকগুলি “আমল” দেখে ফেলেছে এবং এর মধ্যে অনেক সময়েই ভারতীয় ক্রিকেট তাঁর প্রতি সুবিচার করেনি। এবং ‘উদাসীন’ এই ক্রিকেটারের তাতে কিছু এসে যায়নি। ভারতীয় ক্রিকেটে এক বিরল ও আনসাং চরিত্র হয়েই থেকে গেছেন আজ ৩৫-এ পা দেওয়া এই ক্রিকেটার। গত কয়েকটি টেস্টে তাঁর খারাপ প্রদর্শন কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে যে তাঁর শেষ টেস্টও তিনি খেলে ফেলেছেন কিনা! এই কৌতূহল নিরসনের চাবিকাঠি এখন সময়ের হাতে।
ভারতীয় ক্রিকেটের মূল মঞ্চে তাঁর “উঠে আসা” ছিল বেসিকস ঠিক রাখার জন্য নিরলস পরিশ্রম আর নিজের উপর ঐকান্তিক আস্থার ফসল। অন্ততঃ প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে তাঁর পারফরমেন্সে ধরা আছে সেসব কথা। ১৬৭টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ৩৬টি শতক (সর্বোচ্চ অপরাজিত ২৬৫) ও ৫৩টি অর্ধশতকসহ ১১,৯৮১ রান এই বক্তব্যের স্বপক্ষেই কথা বলে। প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে তাঁর পারফরমেন্সের জোরেই ২০০৭-এ নিউজিল্যান্ডগামী অনূর্দ্ধ-১৯ ভারতীয় দলে স্থান পাওয়া এবং ২টি শতরান করে টিমে রাখার মর্যাদা দিয়েছিলেন তিনি। এরপরে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য মহম্মদ নিসার ট্রফিতে খেলার জন্য নির্বাচিত হন। এরপরে বছর কয়েক ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর সাফল্য অব্যাহত থাকলেও এবং ভারতীয় টিমে নির্বাচিত হলেও চূড়ান্ত ভারতীয় একাদশে জায়গা করে নেওয়া কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না তাঁর পক্ষে। ২০১১-তে ওডিআই আর টি২০ অভিষেক হয়ে গেলেও টেস্টে ডাগ-আউটের চিরস্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাবার মুখে ভাগ্য হাত বাড়িয়েছিল ২০১৩ সালে, তাঁর টেস্ট অভিষেকের মুহূর্তে। এবং সে হাত বাড়ানো ছিল তাঁর টেস্ট কেরিয়ারের শুরুতেও।
২২শে মার্চ ২০১৩। শিখর ধাওয়ানের বাঁ হাতে চোট আর গৌতম গম্ভীরের জন্ডিস তাঁর সামনে খুলে দিয়েছিল টেস্ট ক্রিকেটের দরজা, বর্ডার-গাভাসকার টেস্ট সিরিজে, দিল্লীতে। সেই মুহূর্তে মে, ২০০৭-এর পরে তিনিই ছিলেন মুম্বাই থেকে সুযোগ পাওয়া প্রথম টেস্ট ক্রিকেটার। প্রথম ম্যাচে তিনি দু-অঙ্কের রান পাননি (৭ ও ১) । তবু, সেই অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ভারত সিরিজ ৪-০ জেতায় পরের ২-টেস্টের সিরিজে ২০১৩-১৪-তে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ভারতীয় দলে তাঁর সুযোগ পাওয়া এবং স্টেন-ফিল্যান্ডার-মর্কেল এঁদেরকে খেলে ডারবানে ৯৬ সহ সিরিজে ২০৯ রান করা, ৬৯.৬৬ গড়ে। ডাগ-আউটে বসার লম্বা দিনগুলিকে ওইখানেই গোধূলিতে পৌঁছে দেন তিনি। পড়ে-পাওয়া সুযোগকে খুব কমবারই ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনি, তাঁর টেস্ট কেরিয়ারে। তার পরের সিরিজে ১৫ই ফেব্রুয়ারি ২০১৪-তে এসেছিল তাঁর প্রথম টেস্ট শতরান, নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে, ওয়েলিংটনে।
এরপরে কিছু অনন্য টেস্ট কীর্তি তিনি ভরে ফেলেন তাঁর টেস্ট কিটিতে।
১) লর্ডসে আবির্ভাবেই তাঁর আছে টেস্ট শতরান, ২০১৪তে, ৪র্থ ভারতীয় হিসেবে। বাকি ৩ জন – দিলীপ বেঙ্গসরকার (১৯৭৯), সৌরভ গাঙ্গুলী (১৯৯৬) আর অজিত আগরকার (২০০২)।
২) ভিনু মানকাদের পরে তিনিই ২য় ভারতীয় ক্রিকেটার, যিনি মেলবোর্ণে ২টি শতরান করেছেন টেস্টে (২০১৪ আর ২০২০)।
৩) শ্রীলঙ্কার গলে এক টেস্টে উইকেটকিপার না হয়েও ৮টি ক্যাচ নিয়েছেন তিনি ১৪ই আগস্ট ২০১৫ তারিখে। এই রেকর্ডটি এখনো একক ও অটুট।
৪) ডিসেম্বর ২০১৫-তে দিল্লীতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে তিনি উভয় ইনিংসেই শতরান (১২৭ ও অপরাজিত ১০০) করেন, ৫ম ভারতীয় হিসেবে। বাকি ৪ জন – ১ বার বিজয় হাজারে (১৯৪৮-এ অ্যাডিলেডে ১১৬ ও ১৪৫), ৩ বার সুনীল গাভাসকার (১৯৭১-এ ত্রিনিদাদে ১২৪ ও ২২০, ১৯৭৮-এ করাচিতে ১১১ ও ১৩৭, ১৯৭৮-এ কলকাতায় ১০৭ ও অপরাজিত ১৮২), ২ বার রাহুল দ্রাবিড় (১৯৯৯-এ হ্যামিলটনে ১৯০ ও অপরাজিত ১০৩, ২০০৫-এ কলকাতায় ১১০ ও ১৩৫) আর ১ বার বিরাট কোহলি (২০১৪-তে অ্যাডিলেডে ১১৫ ও ১৪১)। পরে রোহিত শর্মাও এই কৃতিত্বের অধিকারী হন ২০১৯ সালে (ভাইজাগে ১৭৬ ও ১২৭)।
৫) চিরদিনের স্টপ-গ্যাপ অধিনায়ক তিনি আজ অবধি ৫টি টেস্টে ভারতের অধিনায়কত্ব করেছেন, আর তার মধ্যে ৪টিই জিতেছে ভারত, ১টি ড্র হয়েছে। ওডিআই-তে ৩টি ম্যাচে তিনি ভারতের অধিনায়কত্ব করেছেন, যার সবকটিই জিতেছে ভারত। আর টি২০তে ২টি ম্যাচে তিনি ভারতের অধিনায়কত্ব করেছেন, যার মধ্যে ১টি জিতেছে ১টি হেরেছে ভারত।
তাঁর অধিনায়কত্বে জেতা টেস্ট জয়গুলি এইরকম:-
ক) ২৫-২৯ মার্চ ২০১৭ ধরমশালাতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৪র্থ টেস্টে তিনি প্রথমবার ভারতের অধিনায়ক হন, বিরাট কোহলির চোট থাকায়। ৫ দিনের টেস্ট ৪র্থ দিনেই ৮ উইকেটে জিতে নিয়েছিল ভারত। অস্ট্রেলিয়ার ৩০০ ও ১৩৭ রানের জবাবে ভারত করেছিল ৩৩২ ও ১০৬/২ রান। তিনি রান করেছিলেন ৪৬ আর অপরাজিত ৩৮।
খ) ২০১৮র ১৪-১৮ জুন বেঙ্গালুরুতে আফগানিস্থানের বিরুদ্ধে একমাত্র টেস্টে তিনি দ্বিতীয়বার ভারতের অধিনায়ক হন, আবার বিরাট কোহলি না থাকায়। এবার ৫ দিনের টেস্ট ২ দিনেই ইনিংস ও ২৬২ রানে জিতে নিয়েছিল ভারত। ভারতের ৪৭৪ রানের জবাবে আফগানিস্থান করেছিল ১০৯ আর ১০৩ রান। একমাত্র ইনিংসে তিনি রান করেছিলেন ১০।
গ) বিরাট কোহলির নেতৃত্বে অ্যাডিলেডে ১ম টেস্টে ২য় ইনিংসে ৩৬ রানে অল-আউট ভারত শোচনীয়ভাবে হেরে যাবার পরে ২০২০-২১-এর অস্ট্রেলিয়া সফরের শেষ ৩ টেস্টের জন্য স্টপ-গ্যাপ অধিনায়ক (আবার বিরাট কোহলি না থাকার সৌজন্যে) তিনি মেলবোর্ণের ২য় টেস্টে শতরান করেন (১১২ রান) ১ম ইনিংসে, সঙ্গে করেন দারুণ অধিনায়কত্ব। ২৬-২৯ ডিসেম্বর ২০২০র টেস্ট ৪ দিনেই ৮ উইকেটে জিতে নেয় ভারত। অস্ট্রেলিয়ার ১ম ইনিংসে ১৯৫ রানের জবাবে তাঁর ১১২ রানে ভর দিয়ে ১ম ইনিংসে ৩২৬ রান করে ভারত। ২য় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া করে ২০০ রান আর ভারতের ২য় ইনিংসে ৭০/২ রানের মধ্যে তিনি অপরাজিত ২৭ রান করেছিলেন। তাঁর অধিনায়কত্বে পরের টেস্ট ড্র হয় সিডনিতে।
ঘ) ওই ২০২০-২১-এর অস্ট্রেলিয়া সফরেই ৪র্থ বা শেষ টেস্টে তাঁর অধিনায়কত্বে ৩ উইকেটে জিতে ২-১ ম্যাচে সিরিজ পকেটে পুরে বর্ডার-গাভাসকার ট্রফি জিতে নেয় ভারত। ২০২১-এর ১৫-১৯ই জানুয়ারি ব্রিসবেন টেস্টে অস্ট্রেলিয়া করে ৩৬৯ রান আর ২৯৪ রান, দুই ইনিংসে। জবাবে ভারত ২ ইনিংসে করে ৩৩৬ রান আর ৩২৯/৭ রান, যার মধ্যে তাঁর অবদান ছিল ৩৭ রান আর ২৪ রান। এবং ২য় ইনিংসে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে যাওয়া স্টিভ স্মিথের ক্যাচ।
ক্রিকবাজ তাঁকে সসম্মানে পরিচয় করিয়ে দেয় এইভাবে:- “A dressing room full of tattooed arms, gelled hair, peroxide highlights and dabbing twenty-somethings defines the post-Tendulkar era of Indian cricket. Amidst all the glitter and spunk of the youthful Indian dressing room, a quiet young man of short stature was the unlikely outcast.” সত্যিই আজকের “শক্তি”মান ভারতীয় ব্যাটিং লাইন-আপে এক ঊজ্জ্বল ব্যতিক্রমী শিল্পের ছোঁয়ার নামই অজিঙ্ক্য রাহানে। তাঁর জমাট টেকনিকের কারণে ব্যাটিংয়ের সময়ে ক্রিজে তাঁর ব্যালান্স আজকের ভারতীয় টেস্ট ব্যাটিংয়ে ঈর্ষণীয়। তাঁর দৃষ্টিনন্দন স্ট্রোক-প্লে সেই কথাই বলে।
ভারতীয় ক্রিকেটে এবং নিজের জীবনে আদর্শ “ফ্যামিলি ম্যান” অজিঙ্ক্য রাহানে আজ ৬ জুন ৩৪ পেরিয়ে ৩৫-এ পা দিলেন। খুব ভাল থাকুন অজিঙ্ক্য রাহানে। কেকেআর-এর হয়ে আইপিএল খেলার সময় পাওয়া হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট কাটিয়ে ভারতের টেস্ট টিমে ফিরুন নিজের ব্যাটের জোরে। তিনি জানেন সেই কাজটা খুব কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।
শুভ জন্মদিন, ভারতের মুশকিল-আসান ক্রিকেট অধিনায়ক।