বেঁচে থাকলে আজ ৬৪ পেরিয়ে গিয়ে ৬৫-তে পা দিতেন এই ভদ্রলোক।
গত শতাব্দীর শেষ বছরের ৪ঠা নভেম্বর মৃত্যুর কয়েকদিন আগে জীবনের রানআপের শেষ ধাপে পৌঁছে ১৯৫৮ সালের ১৮ই এপ্রিল তারিখে জন্মানো এই ফাস্টবোলারের ওজন হয়ে গিয়েছিল মাত্র ২৫ কেজি। কোলনের ক্যানসার তার জীবন কেড়ে নিয়েছিল মাত্র ৪১ বছর বয়সেই। এরচেয়েও বেদনাদায়ক ঘটনা ছিল এটাই যে মৃত্যুর মাসদু’য়েক আগে তিনি বিয়ে করেছিলেন কোনি রবার্টা আর্লে-কে। মৃত্যু আসন্ন জেনেও তাঁদের সম্পর্ককে সামাজিক সম্মান দিতে। বিশ্বের সেরা পেসারদের অন্যতম মেনে তাঁর মৃত্যুর দশ বছর পরে, ২০০৯ সালে আইসিসি “ক্রিকেট হল অফ ফেম”-য়ে জায়গা দিয়েছিল তাঁকে। উইজডেন তাঁকে জায়গা দিয়েছিল বিশ্বের সর্বকালীন সেরা টেস্ট একাদশে।
বার্বাডোজের ব্রিজটাউনে জন্মানো তিনি এক বছর বয়সে হারান তাঁর পুলিস ও ক্রিকেটার বাবাকে, একটি ট্রাফিক দুর্ঘটনায়। স্কুলজীবন চলাকালীনই তাঁর দাদু তাঁকে ক্রিকেটের পেস বোলিংয়ের পাঠে দীক্ষিত করে তোলেন, যার ভরনপোষণেই বড় হয়ে ওঠেন এই কিশোর পেসার। ১৮ বছর বয়সে ১৯৭৬-এ প্রথম সুযোগ পান তার কর্মক্ষেত্র ব্যাঙ্কস ব্রুয়ারির ক্রিকেট টিমে। প্রথম ম্যাচে ব্যর্থতায় না দমে ফিরে আসা।বার্বাডোজের হয়েও ১৩/০২/১৯৭৮-এ প্রথম ম্যাচে আবার শোচনীয় ব্যর্থতা – শূন্য রান আর শূন্য উইকেট। চারদিন পরে জামাইকার বিরুদ্ধে শূন্য রান কিন্তু ৭৭ রানে ৬ উইকেট।
এর ভিত্তিতেই ভারতে সফরকারী ওঃ ইন্ডিজ দলে স্থান পাওয়া (কেরি প্যাকারের বিশ্ব সিরিজ ক্রিকেটে নামীদামী পেসাররা চলে গিয়েছিলেন)। দলে নির্বাচনের খবর তিনি শোনেন ব্যাঙ্কস ব্রুয়ারির স্টোররুমে কর্মরত অবস্থায়। পরে তিনি জানান, সে সময় তাঁর কোন ধারণা ছিলনা, ভারত কোথায়! ১৫ই ডিসেম্বর ১৯৭৮-এ শুরু হওয়া সফরের ২য় টেস্টেই, ব্যাঙ্গালোরে (তখনো বেঙ্গালুরু জন্ম নেয়নি) প্রথম একাদশে চলে আসেন তিনি। সেই সফরে প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ৩৭টি উইকেট নিলেও তাঁর খেলা তিনটি টেস্টে উল্লেখযোগ্য কিছু করতে ব্যর্থ হন তিনি। কিন্তু হ্যাম্পশায়ারে ডাক পেয়ে যান ১৯৭৯-তে, যেখানে ১৯৯৩ পর্যন্ত তাঁর স্থান ছিল বাঁধা।
১৯৮০/৮১-তে ও ১৯৮১/৮২-তে টেস্ট টিমের বাইরে ছিলেন। ফিরে এসে ১৯৮২/৮৩ থেকে ১৯৮৫/৮৬-র মধ্যে, পরপর ৭টি টেস্ট সিরিজেই তাঁর উইকেট ছিল ২১ বা তার বেশী। এর মধ্যে ১৯৮৪তে ইংল্যান্ডকে ব্ল্যাকওয়াশ (৫-০) করার সিরিজে তিনি ২৪টি উইকেট নেন (জোয়েল গার্নারের ছিল ২৯টি উইকেট) আর ১৯৮৩/৮৪-তে ভারতকে ৩-০ ম্যাচে হারিয়ে দেবার সিরিজে তিনি নিয়েছিলেন ৩৩টি উইকেট এবং ১ম টেস্টে কানপুরে করেন কেরিয়ার-সেরা ৯২ রান। টেস্টে কেরিয়ার-সেরা এক ইনিংসে ৭/২২ করেন তিনি ১৯৮৮-তে, ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে এবং ঐ সিরিজে ৫ টেস্টে নেন ৩৫টি উইকেট। ভারতের বিরুদ্ধে পোর্ট অফ স্পেনে ১৯৮৯-তে তাঁর টেস্টে কেরিয়ার-সেরা এক ম্যাচে ১১/৮৯ করেন তিনি। ৮ই আগস্ট ১৯৯১ তারিখে ১২ বছরেরও বেশী স্থায়ী টেস্ট কেরিয়ারে ৮১ টেস্টে তিনি ৩৭৬টি উইকেট নেন, কেরিয়ার সেরা বোলিং ছিল ৭/২২। তাঁর শেষতম টেস্ট উইকেট ছিলেন গ্রাহাম গুচ, ওভালে। ১৯৮০/৮১ আর ১৯৮১/৮২, এই দু’বছর বাদ না গেলে ১০০ টেস্ট ও ৪০০ উইকেটের মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলা অসম্ভব ছিলনা তাঁর পক্ষে। টেস্টে ২০০র বেশী উইকেট নেওয়া বোলারদের মধ্যে সেরা গড় ছিল তাঁর – ২০.৯৪। তিনি টেস্টে ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন ২২ বার ও ইনিংসে ১০ উইকেট নিয়েছেন ৪ বার। টেস্টে তাঁর নেওয়া ক্যাচের সংখ্যা ছিল ২৫।
ভয়াবহতায় অনেক বেশী ছিলেন তিনি একদিনের ক্রিকেটে, যার শুরু হয়েছিল ২৮শে মে, ১৯৮০ সালে।ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬-তে একটি ওডিআই ম্যাচে মাইক গ্যাটিংয়ের নাকের হাড় ভাঙ্গে তাঁর বাউন্সারে, পরের বল করার আগে তিনি আবিষ্কার করেন যে হাড়ের টুকরো বলের চামড়ায় জড়িয়ে ছিল। ১৯৭৯-র টিমে থাকলেও সেই বিশ্বকাপে একটি ম্যাচও খেলা হয়নি তাঁর। তবুও ৩টি বিশ্বকাপে খেলেন তিনি, ১৯৮৩, ১৯৮৭ আর ১৯৯২। ১৯৮৩ আর ১৯৮৭-তে সফল তিনি ১৯৯২-তে চূড়ান্ত ব্যর্থ হন, সংগ্রহ ছিল ৫ ম্যাচে ২ উইকেট। ২টি উইকেটই ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে – সেটাই ছিল তাঁর একমাত্র ম্যাচ। পরে ১৯৯২/৯৩ আর ১৯৯৩/৯৪ সালে এবং ১৯৯৫/৯৬ সালে নাটালের হয়ে খেলার সময়ে তাঁর অভিজ্ঞতা পুষ্ট করেছিল শন পোলককে শন পোলক হয়ে উঠতে। ১৯৯২ বিশ্বকাপেই তাঁর “একদিন” কেরিয়ার শেষ হয়ে যায় ৮ই মার্চ ১৯৯২ সালে, নিউজিল্যান্ড ম্যাচশেষে। প্রায় ১২ বছরে ১৩৬টি ওডিআই ম্যাচে ১৫৭ উইকেট পান তিনি, কেরিয়ার সেরা বোলিং ছিল ৪/১৮। ওডিআই-তে তাঁর নেওয়া ক্যাচের সংখ্যা ছিল ১৫।ওডিআই-তে ৬ বার তিনি ম্যাচে ৪ উইকেট পেয়েছিলেন।
তীব্র গতি, স্থির লক্ষ্যের বাউন্সার, দু’দিকেই স্যুইং করানোর ক্ষমতা, ঘাতক ইনস্যুইং ইয়র্কার এবং হিমশীতল চাউনি এই বোলার কে স্থায়ী মধ্যমণির আসন করে দিয়েছে বিশ্বসেরা ফাস্টেস্ট বোলারদের সারিতে। তিনি বল হাতে ছুটে আসছেন, এই দৃশ্য ১২ বছরের মত একটা দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্বের তাবড় তাবড় ব্যাটসম্যানদের দুঃস্বপ্ন ছিল। ৬ ফুটেরও কম উচ্চতার কোন পেসারের এতটা সাফল্য ছিল অবাক করার মত। অকালে জীবনের ম্যাচ হেরে না গেলে এখনও বিশ্বক্রিকেটের সেরা সেরা পেসার তৈরীতে নিশ্চয়ই মগ্ন থাকতেন তিনি।
শুভ জন্মদিন, ম্যালকম ডেনজিল মার্শাল।