আমার মতে, যার চেয়ে বড় “বাঙালী” ক্রিকেটার খুব কমই দেখেছি জীবনে, তাকে নিয়ে এই লেখাটা। যিনি দিল্লীর লোক হয়েও দিল্লীর হয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলেছিলেন মাত্র চার বছর (১৯৭৭-৭৮ থেকে ১৯৮০-১৯৮১) আর বাংলার হয়ে খেলেছিলেন পনেরো বছর (১৯৮১-৮২ থেকে ১৯৯৫-৯৬)।
১৯৮৯-৯০। যে বছর এখনো অবধি শেষবারের জন্য রণজি ট্রফি জিতেছিল বাংলা। সম্বরণ ব্যানার্জির অধিনায়কত্বে। অঘোষিত লীডার ছিলেন অন্য একজন। তার ৬/৭ বছর আগে থেকেই মনের বাসিন্দা হয়ে গেছেন তিনি। তার খেলা, ব্যবহার, মানবিকতা আর স্বচ্ছ লড়াকু দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য। ও হ্যাঁ…কলকাতার তার ক্লাবের নাম ছিলো মোহনবাগান।তিনি অরুণলাল।একেবারে শেষের দিকে, এক বছর ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলেছিলেন তিনি।
ঐ রণজিতেই অনেক সমস্যা ছিল সেবার বাংলা দলে।যার মধ্যে অরুণলাল-সম্বরণ ব্যানার্জী আর অরুণলাল-রাজা বেঙ্কট বিপ্রতীপ সমীকরণ ছিল একদম দৃশ্যমান।তবু মাঠে নামার পরে সেসব সমস্যা মিলিয়ে গিয়ে শুধু চোয়াল চাপা লড়াইয়ের শপথে চাঙ্গা থাকত “টিম বাংলা”।ঐবারের রণজি ফাইনালে অরুণলালের ব্যাটিং আজও স্পষ্ট মনে পড়ে।ঐরকম “আউট হবনা” মানসিকতা তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সব সতীর্থর মধ্যে, যার ফলশ্রুতিতে দিল্লী সেবার ফাইনালে হার মানে কোশেন্টে।মানসিকতাই মস্ত সম্বল ছিল অরুণলালের, টেকনিক ছাড়াও।যার প্রতিফলন ১৬টি টেস্টে ৭২৯ (সর্বোচ্চ ৯৩) বা ১৩টি ওডিআই-তে ১২২ (সর্বোচ্চ ৫১) রানে ধরা নেই।তবু ৬টি টেস্ট অর্ধশতক আর ১টি ওডিআই অর্ধশতক ছিল তার নামে। কিন্তু তার টেকনিক আর মানসিকতার আলোয় হাজার ওয়াটের আলোর মত উজ্জ্বল ছিল তার প্রথম শ্রেণীর ব্যাটিং পরিসংখ্যান, যা দেখায় ১৫৬ ম্যাচে ২৪১ ইনিংসে ১০৪২১ রান (সর্বোচ্চ ২৮৭) আর তার মধ্যে ৩০টি শতরান আর ৪৩টি অর্ধশতক।
তারপর ক্রমে অবসর, একটু আড়াল, টিভি কমেন্ট্রি এবং এরপর হঠাৎ টিভি কমেন্ট্রি না করা। যা হয়, খবরে না থেকে মনে আছেন। ২৪শে এপ্রিল ২০১৬ তারিখে হঠাৎ তিনি আবার খবরে। বাংলা মিডিয়ায়। লড়াকু লোকটি লড়ে যাচ্ছেন চোয়ালে ক্যান্সার-এর বিরুদ্ধে (১৪ ঘন্টার দীর্ঘ অপারেশন যে লড়াইয়ের অঙ্গ ছিল)। সেই চোয়াল, যা মাঝে মাঝেই বিসিসিআই-র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল বলে অনেক বেশী যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ১৬ টেস্ট আর ১৩ একদিনের ম্যাচে থেমে গিয়েছিল তার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জীবন।তারপর?
তারপর আর কি? চিরলড়াকু তিনি আরো শক্তিশালী চোয়াল নিয়ে ফিরে এলেন জীবনে এবং ক্রিকেটেও। গত দু’বারের বাঙলা ক্রিকেট দলের মেন্টর / হেডকোচ হয়ে। কথা বলতে তখনো কষ্টে তিনি।তবু হতশ্রী এবং আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বদীর্ণ বাঙলা ক্রিকেট দল তারই শরণাপন্ন হল ২০১৮-১৯য়ে, রণজিতে ভাল কিছু করার জন্য। সেবার পারেননি, কোয়ার্টার ফাইনালেও যায়নি সেবার বাংলা।
২০১৯-২০র চ্যালেঞ্জটাও খুব কঠিন ছিল। অফ ফর্মের মনোজ, সুদীপ, রমন, ঈশ্বরণকে সামলানো, দিন্দাকে এড়িয়ে যাওয়া, একসূত্রে দলকে বাঁধা এবং সর্বোপরি ফিটনেসে চূড়ান্ত লেভেলে দলের প্রত্যেককে নিয়ে যাওয়া…..এই সবকটা কাজ ঐশ্বরিক দক্ষতায় করে দেখালেন তিনি, ফাইনালে যাওয়া অবধি।অনুষ্টুপ-মনোজ-ঈশান-মুকেশ-আকাশদীপ-শাহবাজদের সঙ্গে একবার অন্ততঃ অস্ফুটে উচ্চারণ করুণ এই ভদ্রলোকের নাম, একবার অন্ততঃ অবচেতনেও মনে করুন এই লড়াইর প্রতিশব্দ ভদ্রলোককে, পরপর রাজস্থান-পাঞ্জাব-কর্ণাটককে সরাসরি হারিয়ে বাংলার ফাইনালে যাওয়ার অদৃশ্য নায়ক হিসেবে। শেষ পর্যন্ত ফাইনালটা রাজকোটে সৌরাষ্ট্রর কাছে হেরে গিয়েছিল বাংলা।
সোজা ছিলনা ২০২১-২২য়ের চ্যালেঞ্জটাও। গ্রুপের সব ম্যাচ জিতে কোয়ার্টার ফাইনালে ১ম ইনিংসের ফলে ঝাড়খন্ডকে (২৯৮) হারাবার পথে অরুণলালের কোচিংয়ে বাংলার ১ম ইনিংসে (৭/৭৭৩) ৯জন ব্যাটারই (যারা ব্যাট করেছিলেন) অর্ধশতাধিক রান করেছিলেন।কিন্তু সেমিফাইনালে সেই ব্যটিং ভরাডুবির কারণেই ১৭৪ রানে হেরে যায় বাংলা, মধ্যপ্রদেশের কাছে।
এর মধ্যে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন তিনি এবং ছেড়ে দিয়েছেন বাংলা দলের কোচের পদ, যেখানে এখন অধিষ্ঠিত হয়েছেন লক্ষ্ণীরতন শুক্লা।বর্তমানে একটি মার্সিডিজের মালিক অরুণলালকে সেটি উপহার দিয়েছেন ক্রিকেটের বাইরের এমন একজন, কয়েক দশক আগে যার জীবনের উথ্থানে রূপকথাসম সক্রিয় ভূমিকা ছিল অরুণলালের এবং তার প্রথম স্ত্রীর।অরুণলালের আপ্রাণ লড়াই আলোকবর্তিকা হয়ে থাকুক আগামীর বাংলা ক্রিকেটেও।
আজ অরুণলালের ৬৮তম জন্মদিন।
জন্মদিনের শুভেচ্ছা নিন অরুণলাল।