বেন স্টোকসের কখনও জিওফ্রি চসারের সান্নিধ্য পাওয়া হয়নি। জন্মসালের ব্যবধান বিস্তর। তাই সম্ভবও নয়। তবু দু’জনকে মিলিয়ে দেয় ক্যান্টারবেরি। চসারের ‘ক্যান্টারবেরি টেলস’ ইংরেজি সাহিত্যের মূল্যবান সম্পদ। অপরজন বিশ্বের অন্য প্রান্তের এক ক্যান্টারবেরি থেকে উঠে এসে ইংলিশ ক্রিকেটের সম্পদ হয়েছেন। সম্প্রতি ক্রিকেটের সনাতন ফরম্যাটে জো রুটের উত্তরসূরি নির্বাচিত হয়েছেন স্টোকস। এই চরিত্রকে ঘিরে বিতর্কের অন্ত নেই। একটা সময় পর্যন্ত ইংলিশ ক্রিকেটের ব্যাড বয় ছিলেন। অথচ তাঁর সাফল্য অনায়াসে গ্রহণের চাঁদের মতো গিলে খায় সব নেতিবাচকতাকে।
স্টোকস দায়িত্ব নিতে ইংলিশ ক্রিকেট যেন নতুন করে বাঁচার উদ্যম পেল। হাসপাতালের শয্যায় মৃত্যু পথযাত্রীও যে আশা দেখেন চিকিৎসককে দেখে, ইংল্যান্ডের কাছে স্টোকস লাল বল ক্রিকেটের সেই চিকিৎসক। সব খারাপের অবসান এখানেই। এবার নতুন পথ চলা― নিঃসন্দেহে স্টোকস দায়িত্ব নেওয়ায় এই বিশ্বাস তৈরি হয়েছে ইংল্যান্ড ক্রিকেটে।
জীবনে গুরুত্বপূর্ণ যা যা ঘটেছে, তার অনেক কিছুই না ঘটতেই পারত। তা নিউজিল্যান্ড ছেড়ে ইংল্যান্ডে আসাই হোক, রাগবি ছেড়ে দিয়ে ক্রিকেটে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করাই হোক অথবা ২০১৯ বিশ্বকাপের শেষ ওভারে তাঁর ব্যাট ছুঁয়ে ওভারথ্রো। স্টোকসকে ঘিরে একটা অপ্রত্যাশিত–র বলয় আগাগোড়া ছিল। আসলে ক্রিকেটই তাঁর ভবিতব্য।
রাগবিতে দুরন্ত ছিলেন। ফুল ব্যাক খেলতেন। ১৪ বছর বয়সে একটি ম্যাচে বিপক্ষ খেলোয়াড়রা তাঁকে টপকে অনায়াসে স্কোর করছিল। স্টোকস তাতে মোটেই উদ্বিগ্ন ছিলেন না। তাঁর এই ঔদাসীন্য জীবনে একটা তাৎপর্যপূর্ণ উপলব্ধি এনে দিয়েছিল― রাগবি নয়, তাঁর ভালোবাসা ক্রিকেটই। ভাগ্যিস সেদিন রাগবি একরত্তি স্টোকসের কাছে বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল! নয়তো বিশ্বক্রিকেটের কাছে বেন স্টোকস নামক বর্ণময় চরিত্র অদেখা-ই থেকে যেত।
সময়ের চেয়ে বড় শিক্ষক এই দুনিয়ায় কেউ নেই। স্টোকসের কাছেও বিষয়টা তেমন। জীবনে পা ফেলতে গিয়ে বারবার ভুল করেছেন। কিন্তু সেখান থেকে শিক্ষা নিয়েছেন, তার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে কখনও। ২০১৪-তে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে তৃতীয় টি২০-তে প্রথম বলেই রান আউট হন। নিজের আবেগকে দমিয়ে রাখতে পারেননি। ফিরে এসে ড্রেসিংরুমের লকারে সজোরে ঘুষি মারেন স্টোকস। আঙুলে গুরুতর চোট পেয়ে ২০১৪ টি২০ বিশ্বকাপ থেকেই ছিটকে যান। ওই ঘটনার পর বলেছিলেন, ‘মাঠের বাইরে এমন আবেগ কখনওই দেখাব না, যে কারণে চোট পেতে হয়।’
২০১১-তে মদ্যপ অবস্থায় পুলিশকে বাধা দেওয়ার ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তার দু’বছর পর অস্ট্রেলিয়া সফরে মদ্যপানের নিয়ম লঙ্ঘন করায় স্টোকসকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। বেপরোয়া গতির কারণে ২০১৬ সালে চারবার জরিমানা হয় স্টোকসের। পরবর্তী ছ’মাসে আর একবারও একই অভিযোগে অভিযুক্ত হলে গাড়ি চালানোয় নির্বাসনের মুখে পড়তে হত। ব্রিস্টলের পানশালার বাইরে মারপিট করে সব খোয়াতে বসেছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে কোর্টে শুনানির পর নিষ্কৃতি মিলেছিল। মারলন স্যামুয়েলস বা বিরাট কোহলির সঙ্গেও বিতর্কে জড়িয়েছেন।
অন্যদিকে, ২০১৯ বিশ্বকাপ ফাইনালে ইংল্যান্ড ৮৬/৪ হয়ে যাওয়ার পর স্টোকসই ছিলেন রক্ষাকর্তা। তাঁর ব্যাট থেকে আসে অপরাজিত ৮৪ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস। ঠিক এক মাস পর হেডিংলিতে জীবনের সেরা ইনিংস উপহার দেন। অ্যাশেজের তৃতীয় টেস্টে অবিশ্বাস্য জয় এনে দেন ইংল্যান্ড অলরাউন্ডার। ১৩৫ রানে অপরাজিত থাকা তাঁর কৃতিত্বকে মোটেই বর্ণনা করে না। ওই ম্যাচে ইংল্যান্ডের একাদশতম ব্যাটার জ্যাক লিচকে সঙ্গে নিয়ে ৭৬ রানের জুটি গড়ে ঐতিহাসিক টেস্ট জয়ের সাক্ষী রেখেছিলেন ক্রিকেট দুনিয়াকে। বেন স্টোকস আসলে স্কুল জীবনের সেই ছেলেটা, যে দুষ্টুমি করে শিক্ষকদের নাজেহাল করলেও পরীক্ষায় প্রথম হয়। সাত খুন মাপ করে সেই দস্যি ছেলেকেই শিক্ষকরা সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসে।
২০১৯ ক্রিকেট জীবনে পরম প্রাপ্তির যেমন, তেমনই চরম হতাশার। সে-বছর ব্রিটেনের জনপ্রিয় সংবাদপত্র দ্য সান একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। স্টোকসের অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং পারিবারিক একটি গোপন খবর প্রকাশ্যে আনে তারা। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, স্টোকসের মা ডেবোরার প্রথম পক্ষের স্বামী ডান আত্মঘাতী হওয়ার আগে নিজের দুই সন্তানকে গুলি করে মারে। ঘটনার তিন বছর পর স্টোকসের জন্ম। ওই সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরটি হইচই ফেলে দেয়। স্টোকস ভেঙে পড়েন মানসিকভাবে। ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলেন, ‘শেষ তিন দশক ধরে যে ঘটনাটা আমার মা এবং বাবা একটু একটু করে ভোলার চেষ্টা করছে, ঠিক সেখানেই আঘাত পেল। আমার পরিবারের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় প্রকাশ্যে এনে সব তছনছ করে দেওয়া হল। সাংবাদিকতা কতটা নিচে নামতে পারে, তা বোঝানোর জন্য কোনও ভাষাই যথেষ্ট নয়।’ মানসিকভাবে বিধ্বস্ত স্টোকস সেই সময় পাশে পেয়েছিলেন নামী-দামি ক্রীড়াব্যক্তিত্বকে। এমনকি, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের ইংলিশ স্ট্রাইকার মার্কাস র্যাশফোর্ডও স্টোকসের পক্ষ নিয়ে খবরটির সমালোচনা করেন। দু’বছর পর দ্য সান ক্ষমা চায় এবং আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হয়।
অস্ট্রেলিয়া ভারতের বিরুদ্ধে টেস্ট খেললে এখন নাকি অসি তারকাদের মধ্যে সেই আগ্রাসন দেখা যায় না। এর কারণ হিসেবে প্রাক্তনীরা লোভনীয় আইপিএল-কেই চিহ্নিত করেছেন। আইপিএলের একটা চুক্তি পাওয়ার আশায় ক্রিকেটাররা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন। স্টোকস সেখানে ব্যতিক্রমী। টেস্ট ক্রিকেটে ফোকাস করতে চান, তাই এবারের আইপিএল থেকে নিজেকে সরিয়েছিলেন। স্টোকসদের মতো চরিত্রকে ক্রিকেটের ভীষণ দরকার। তিনি শুধু ইংল্যান্ডকেই বাঁচাবেন না, টেস্ট ক্রিকেটও নতুন করে প্রাণ পাবে নয়া নেতাকে পেয়ে।
ছবি : কলরব রায়ের ব্যক্তিগত পুস্তক সংগ্রহ থেকে