“কট মার্শ বো লিলি” নামের শব্দবন্ধটা আসলে একটা রাস্তার নাম ছিল, যেটা সেই সময়ের বিশ্বসেরা ব্যাটারদের নিয়ে যেত পতনের নিশ্চিত ঠিকানার দিকনির্দেশে। যার বেশ কয়েকটি উপশাখা পরে তৈরী হয়েছিল, যার কোনটিই “কট মার্শ বো লিলি”-র মত ছিলনা। আজ থেকে স্থায়ী “নো এন্ট্রি” হয়ে গেল রাস্তাটা।
তাঁকে ক্রিকেট দুনিয়া ভালবেসে ডাকত “আয়রন গ্লাভস” নামে। গত সপ্তাহে কুইন্সল্যান্ডে অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গিয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হন অস্ট্রেলিয়ার এই প্রাক্তন উইকেটকিপার-ব্যাটার। তৎক্ষণাৎ তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। মার্শের সঙ্গে একই গাড়িতে ছিলেন ওই চ্যারিটি ইভেন্টের ২ কর্মী। প্রাক্তন অজি উইকেটরক্ষকের অবস্থা খারাপ হতে দেখেই তাঁরাই তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যান। এর পর তিনি সংকটজনক অবস্থায় থাকলেও, পরিবারের কাছাকাছি থাকার জন্য তাঁকে অ্যাডিলেডের এক হাসপাতালে স্থানান্তিরত করা হয়।হৃদরোগে ধাক্কা সামলাতে না পেরে কোমায় চলে যাওয়া রডনি আজ খুব সকালে অ্যাডিলেডের সেই হাসপাতালে জীবনের গ্লাভস খুলে রেখে দিতে বাধ্য হলেন।তাঁর মৃত্যুতে আজ গভীর শোকের ছায়া বিশ্ব ক্রিকেটমহলে।
আর আমার জন্য আজ হারিয়ে গেল আমার সত্তর-আশির ছোটবেলার একটা বড় মাপের অসামান্য ক্রিকেট জাদু ভরা গুপ্তধনের বাক্স। হারিয়ে গেল আমার ছোটবেলা তৈরী করে দেওয়া এক স্মৃতির জাদুখিলানের একটি অন্যতম খিলান। কোন “নিরুদ্দিষ্টর প্রতি বিজ্ঞপ্তি”ই আর কোনদিন যাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না।
১৯৭০-১৯৮৪র সময়ফ্রেমে ৯৬টি টেস্ট খেলে ৩৪৩টি ক্যাচ আর ১২টি স্ট্যাম্পিং ছিল উইকেটকিপার-ব্যাটার রডনি মার্শের অর্জন।ওই সময়টায় বিরাট মাপের কোন স্পিনার অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেললে এই ৩৪৩ আর ১২ সংখ্যাদুটি নিঃসন্দেহে আরো অনেকটাই স্ফীতকায় দেখাত। এবং এই হিসেবের বাইরে থেকে গেছে বিশ্ব ক্রিকেট সিরিজে তাঁর ৫২টা “শিকার”। তাঁর প্রখর অনুমানক্ষমতা, উইকেটের দুপাশেই বিদ্যুৎচমকের মত সহজাত গতিবিধি আর পাখির মত উড়ে যাবার দক্ষতা তাকে ওই সময়ের অন্যান্য সেরা উইকেটরক্ষকের (অ্যালান নট, সৈয়দ কিরমানি, জেফ দুজন, ওয়াসিম বারি) কাছে শ্রদ্ধা ও আদর্শর আসনে বসিয়ে দিয়েছিল।উইকেটের “ব্যাক”গ্রাউন্ডে “অভিভাবক” ছিলেন রডনি মার্শ।
১৯৭০ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত টেস্টে ২৬.৫১ গড়ে ৩টি শতরান আর ১৬টি অর্ধশতরানে গড়া ৩৬৩৩ রান আজকের ক্রিকেট অনুরাগীদের কাছে আহামরি না দেখালেও, তখন তাই ছিল। এর কারণ, তখনকার বিশ্বজোড়া বোলারদের সম্ভ্রম জাগানো নামগুলি।এই রানগুলো অর্জিত হয়েছিল রবার্টস-গার্নার-হোল্ডিং-মার্শাল-হেডলি-উইলিস-বথাম-ইমরান-কপিলদের টপফর্মে থাকার সময়ে। আর ১৯৭১ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত মাত্র ৯২টি ওডিআই-তে দেশ পেয়েছিল তাঁকে, আর তাঁর অবদান ছিল ১২০টি ক্যাচ, ৪টি স্ট্যাম্পিং আর ২০.০৮ গড়ে ও ৮২.২৬ স্ট্রাইকরেটে ১২২৫ রান। বাঁহাতি এই ব্যাটার অস্ট্রেলিয়ার প্রথম উইকেটকিপার হিসাবে টেস্টে শতরান করার নজির গড়েছিলেন।
নিছক অঙ্কের হিসাবেও, ৫ টেস্টের এক সিরিজে তাঁর ২৮টি শিকার এখনো বিশ্বে ৩য় সেরা উইকেটরক্ষণ আর বিশ্বকাপ বাদ দিলে ২য় সেরা উইকেটরক্ষণ। টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর ৩৫৫টি শিকার এখনো বিশ্বে ৪র্থ সেরা উইকেটরক্ষণ (তাঁর অবসরের সময়ে এটি বিশ্বসেরা নজির ছিল) আর টেস্ট ও ওডিআই জুড়লে, তাঁর ৪৭৯টি শিকার এখনো বিশ্বে ৭ম সেরা উইকেটরক্ষণ।যদি মনে রাখি, তাঁর অবসরের পরে ৩৮টি বছরেরও বেশি সময় মহাকালের বোবা টানেলে চলে গেছে, তবে এই অঙ্কও তাঁর জন্য দাবী করে বিরাট কুর্ণিশ।তাঁর সমসাময়িক উইকেটকিপারদের মধ্যে এক সিরিজে ৩০০+ রান আর ১৫ ক্যাচ-স্ট্যাম্পিংয়ের তালিকায় ২য় স্থান ছিল তাঁর, অ্যালান নটের পরেই।সামগ্রিকভাবে এটি ছিল বিশ্বে ৪র্থ বিশ্বসেরা নজির।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন যে তাঁকে “আয়রন গ্লাভস” না বলে লিলি-টমসনদের কিপ করার পরে তাঁর গ্লাভস দুটির অবস্থাকে “আয়রনি অফ গ্লাভস” বলা উচিত। ক্রিকেট ছা়ড়ার পর সুরসিক রডনি অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমিকসের মাথায় ছিলেন। দুবাইয়ে আইসিসি-র ক্রিকেট কোচিং অ্যাকাডেমিরও প্রধান ছিলেন রডনি। ২০১৪ সালে, দু’বছরের জন্য তিনি অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। ১৯৮৫ সালে রডনি স্পোর্ট অস্ট্রেলিয়ার “হল অফ ফেম”-এ এসেছিলেন।
ভালো থাকবেন, রডনি মার্শ।আপনাকে শ্রদ্ধা ও প্রণাম, এই লেখায়।