ক্রিকেটঃ সংকুচিত হতে থাকা এক মহাশক্তি?

ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত সফর ছেড়ে বর্তমানে ফিরে আসি। সম্প্রতি আইসিসি প্রত্যেকটি ২০বিশ খেলাকে আন্তর্জাতিক স্টেটাস দিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়াও কিছু associate দেশকে তাদের মান বা গুরুত্বের ওপর ভিত্তি করে আইসিসি ওডিআই স্টেস্টাস দিয়েছে। খেলাটির সম্প্রসারের কথা ভেবেই এসব পদক্ষেপ। 

কিন্তু তাও মনে হয় এগুলি যথেষ্ট নয়, বরং খেলাটির যাতে প্রসার না ঘটে এই প্রচ্ছন্ন লক্ষ্যও বহু ক্ষেত্রে প্রকট হচ্ছে। ৫০ ওভারের বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী দেশের সংখ্যা ১৬ থেকে ১০-এ নামিয়ে আনা হল, ২০২৭ থেকে আবার (মাত্র) ১৪টি দেশ সুযোগ পাবে পৃথিবীর সেরা হওয়ার। বারংবার, আইসিসি বিশ্বকাপ নিয়েও পরীক্ষানিরিক্ষা করেছে, ফরম্যাট বদলেছে, পাল্টে দিয়েছে দেশের সংখ্যা। 

ছবি : আইসিসি

এই দেশের সংখ্যা বাড়ানো-কমানোর পেছনে কিছ স্বাভাবিক কারণ আছে, আছে ইতিহাসের প্রভাব এবং পুনরাবৃত্তিও। “83” সিনেমাতে এক জায়গায় ভারতীয় দলের ওপেনার কৃষ্ শ্রীকান্ত বলছেন সেবারের প্রতিযোগিতার আগে ভারত কেবল একটি খেলা জিতেছিল বিশ্বকাপে। ১৯৭৫-এ ইস্ট আফ্রিকার বিরুদ্ধে। যে ইস্ট আফ্রিকা দলের হয়ে মূলত ভারতীয় বংশোদ্ভূত (গুজরাটিরা) খেলেছিলেন। ক্রিকেটের এই চিরন্তন সমস্যা এখনও বর্তমান। ৫০ ওভারের বিশ্বকাপে এলিট দলগুলিকে টক্কর দেওয়ার ক্ষমতা আর প্রায় কোন দলের নেই। তাই দলের সংখ্যা বাড়ালে বিশ্বকাপের বহু খেলা প্রহসনে পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। বিগত কিছু বিশ্বকাপে এরকম বেশ কয়েকটি হাস্যকর এক-তরফা খেলা হয়েছে।

২০০৭-এর ৫০-ওভার বিশ্বকাপ ভারতের জন্য অভিশপ্ত ছিল এ কথা নতুন করে কাউকে মনে করিয়ে দিতে হবে না। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে ভারত প্রথম রাউন্ডেই বিদায় নেয়। অথচ বিপর্যস্ত এই দলই এই দুই খেলার মাঝে বারমুডার বিরুদ্ধে নেমে ৪১৩ রান তোলে। যেটি এখনও বিশ্বকাপ রেকর্ড। অর্থাৎ দলগুলির দক্ষতা ও অভিজ্ঞতায় এত ফারাক ছিল যে ভারত ওরকম ছন্নছাড়া অবস্থাতেও ছেলেখেলা করেছিল তাদের প্রতিপক্ষের সঙ্গে।

কেউ কেউ বলবেন এ তো ফুটবল বিশ্বকাপেও হয়, জার্মানি সৌদি আরব কে ৮ গোল দেয়, পর্তুগাল এক-তরফা উত্তর কোরিয়াকে হারায়। তফাৎ এখানেই, এই বারমুডা দলটি ২০০৯-এর পর আর ওডিআই খেলেইনি। অদৃশ্য হয়ে গেছে ৫০-ওভারের মঞ্চ থেকে। একমাত্র ক্রিকেটেই associate তকমা দিতে হয় বেশিরভাগ দেশকে, কারণ তারা প্রতিষ্ঠিত দেশগুলির সঙ্গে এক ক্রিকেট বিশ্বে বাস করেনা। এবং ইস্ট আফ্রিকার মত দল এখনও মাঝে-সাঝে নেমে পড়ে হয় বিশ্বকাপকে বিশ্বকাপের রূপ দিতে। ১৯৭৫-এর থেকে ছবিটা তেমন পাল্টায়নি, এটাই ক্রিকেট কর্তাদের ব্যর্থতা। 

বহু বছর ৩২টি দেশের প্রতিযোগিতা ফুটবল বিশ্বকাপ, শীঘ্র সম্প্রসারিত হয়ে ৪৮টি দেশ নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে। ফিফা যেখানে নতুন-নতুন দেশে বিশ্বকাপ নিয়ে যেতে গিয়ে বিতর্কের সম্মুখীন হয়, সেখানে ক্রিকেটের তিন বড়দা, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের আইসিসি প্রতিযোগিতা আয়োজন করার ক্ষেত্রে মৌরসিপাট্টা কায়েম করা হয়েছে। একমাত্র ২০২৪-এর টি২০ বিশ্বকাপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সহ-আয়োজক করা হয়েছে। ভারত, প্রধানত যে দেশের টাকায় ক্রিকেট কর্মযজ্ঞ চলে, তারা আগামী ১০টি আইসিসি প্রতিযোগিতার ৪টের আয়োজন বা সহ-আয়োজন করবে।

ছবি : আইসিসি

ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার বোর্ডের চিন্তা স্পষ্ট, তারা ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি টাকা বিনিয়োগ করে, তাই লাভের গুড়ের লভ্যাংশ তাদেরই পাওয়া উচিৎ। ক্রিকেটের সম্প্রসারণ এই লক্ষ্যের পরিপন্থী। 

বিগত কয়েক দশকে ক্রিকেট মাঠেও মাঠের বাইরের মত সফল দেশ হয়ে উঠেছে ভারত। তাই ভারতেরই কিন্তু ক্রিকেট প্রসারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সদর্থক ভূমিকা নেওয়া উচিৎ।  অথচ ক্রিকেটে অসাম্যের বৃদ্ধিতেই আমরা যেন খুশি।

২০০৩-এর বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল খেলা কেনিয়ায় এই ক’বছরে ক্রিকেট ধ্বসে পড়েছে, এ খবর ক’জন রাখেন? বা রাখতে আগ্রহী? আফ্রিকা থেকে নতুন শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে নামিবিয়া। অথচ সেখানেও শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্য, ক্রিকেটের কলোনিয়াল হ্যাং-ওভার যেন এক অন্তহীন দুঃস্বপ্নের রাত।

আচ্ছা, এখন তো ইউরোপে ঘটা করে ক্রিকেট খেলা হয়, আগে হত না, তাই না? এ তো সংকোচন নয়, প্রসারের ইঙ্গিত। ইন্টারনেট ঘাঁটলেই আপনি দেখবে ইতালি ফুটবলের মত ক্রিকেটেও ফ্রান্সকে টক্কর দিচ্ছে। এবার টিম লিস্টগুলো দেখুন। ইতালির বর্তমান অধিনায়কের নাম গেশান মুরুসিঙ্ঘে। তিনি শ্রীলঙ্কায় জন্মেছিলেন, ২০০৮-এ প্রথম ইতালির হয়ে ক্রিকেট খেলেন।

ফরাসী দলের অধিনায়কের নাম অরুণ আয়াভুরাজু। তিনি ভারতে জন্মান। প্যাটার্নটা পরিষ্কার হচ্ছে বোধহয়। বিশ্বায়নের যুগে সব খেলাতেই অন্য দেশে জন্মানো মানুষ আরেক দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। সমস্যা এতে নেই। সমস্যা তখনই হয় যখন দেশটির পুরো দলটিই প্রায় বিদেশীদের দ্বারা গঠিত হয়। ইতালি, ফ্রান্স, নরওয়ে, এমনকি আইসিসির সাধের ইউএসএ দলের প্রায় সব ক্রিকেটারই হয়ত এশিয়, নয় অস্ট্রেলিয়, বা ইংরেজ বা ক্যারিবিয়ান বংশোদ্ভূত। ইতালি দলে মাত্র একটি নাম পেলাম যার অধিকারী সে দেশেই জন্মেছেন ও বড় হয়েছেন।

সত্যি কথা বলতে কি ক্রিকেট আইসিসির ৯৪টি  associate দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্রিকেটের উল্লেখযোগ্য প্রসার ঘটেনি। এত বছরেও। সম্প্রতি ওমানে আইসিসি বিশ্ব ২০কুড়ির যোগ্যতা নির্ধারণের আসর বসল, অথচ সেই দেশের বেশিরভাগ মানুষ সে খবরই পেলেন না, পেলেও কোন আগ্রহ দেখালেন না। জার্মানিতে গিয়ে খবর নিন, বেশিরভাগ মানুষ জানেনই না তাঁদের দেশের ক্রিকেট দল আছে। আমেরিকায় গিয়ে জিজ্ঞেস করুন, ক্রিকেটের নিয়ম জানেন এরকম লোক পেতে আপনাকে হিমশিম খেতে হবে। দক্ষিণ এশিয় কাউকে পেলে অবশ্য সমস্যা নেই। আমরা যেখানেই যাই ক্রিকেট নিয়ে যাই।

স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল ১৯৯৬-এর বিশ্বকাপে কেনিয়ার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে রূদ্ধশ্বাস জয়, বাংলাদেশের প্রথমবার বিশ্বকাপে নেমেই পাকিস্তানকে হারানো। বা ২০১১-র বিশ্বকাপে আয়ার্ল্যান্ডের ইংল্যান্ড জয়। এই মুহূর্তগুলিই একটি খেলাকে জিইয়ে রাখে। বাংলাদেশ, আয়ার্ল্যান্ড-এর উত্থান আশা জাগায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই ঘটনাগুলি বড্ড বিরল হয়ে পড়ছে বর্তমানে।

(ক্রমশ)