অঘটন-ঘটনপটীয়সী বিশ্বকাপ থেকে যাক ভবিষ্যতের টেমপ্লেট হিসেবে

যাঁরা আমাকে অল্পবিস্তর চেনেন, তারা খবর রাখেন যে আমি ক্রিকেটের সম্প্রসারণ নিয়ে দরকারের থেকে একটু বেশিই চিন্তিত থাকি। খালি মনে হয় এই খেলাটা মাত্র এই ক’টি দেশই খেলে যাবে চিরটাকাল? কেন প্রথম বিশ্বের দেশগুলির অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ থাকবে না বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ স্তরে? কেন ল্যাটিন আমেরিকা বা পূর্ব এশিয়ার শক্তিধর দেশগুলির দল টেক্কা দেবে না বিশ্বমঞ্চে?

এই নিয়ে আইসিসি বিগত কয়েক বছরে যথেষ্ট সদর্থক ভূমিকা নিয়েছে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এবং সেই লক্ষ্যের বাহন হিসেবে তারা বেছে  নিয়েছে টি২০ ফর্ম্যাটকে। এও সঠিক সিধান্ত। কারণ এ কথা আজ প্রতিষ্ঠিত যে দুম করে টেস্ট-খেলিয়ে দেশ তৈরি হয় না। বহু বছরের ক্রিকেট সংস্কৃতি একটা টেস্ট-নেশন তৈরি করতে পারে। শেষ যে ক’বার আইসিসি একটা দেশকে টেস্ট স্টেটাস দিয়েছে, তাদের হাত পুড়েছে। আয়ার্ল্যান্ড, আফগানিস্থানের কথা ছেড়ে দিলাম, বাংলাদেশের টেস্ট রেকর্ডই ভয়াবহ। 

১৩২টি টেস্টে তারা মাত্র ১৬টি জিতেছে, ৯৮টি হেরেছে। এ কথা নিরাপদেই বলা যায় যে দু দশক টেস্ট ক্রিকেট খেললেও, এবং সে দেশে ক্রিকেট নিয়ে যথেষ্ট উন্মাদনা থাকলেও, লাল বলের আঙ্গিনায় টাইগাররা এখনও সাবালক হয়ে ওঠেনি।

অতঃপর টি২০।এবারের বিশ্ব টি২০র দুটি পর্যায় শেষ হয়ে গিয়ে এবার অন্তিম দ্বৈরথগুলির অপেক্ষায় ক্রিকেটপ্রেমীরা। আমার মতে অবশ্য ক্রিকেটের সুরক্ষিত ভবিষ্যতের নিরিখে এবারের বিশ্বকাপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি রাউন্ড হয়ে গেছে। সেমিফাইনালে পৌঁছেছে ৪টি প্রতিষ্ঠিত দল। সম্ভাব্য বিজেতাদের তালিকায় এদের ধরেছিলেন অনেকেই। অর্থাৎ, এই শেষ তিন খেলায় প্রত্যাশিত খাতেই বইবে বিশ্ব কুড়ি২০। 

কিন্তু এর আগে একের পর এক অপ্রত্যাশিত ফল এবারের টি২০ বিশ্বকাপকে অনন্য করে তুলেছে। এবং সেই জন্যই প্রথম রাউন্ড থেকে সুপার ১২এর যাত্রাপথ এত গুরুত্বপূর্ণ আমার চোখে।

টি২০র বিশ্বে যে চেনা ছক বদলে গেছে তার প্রমাণ আমরা টুর্নামেন্ট শুরু আগেই পেয়েছিলাম। শ্রীলঙ্কা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ, দুই প্রাক্তন চ্যাম্পিয়নকে যোগ্যতা অর্জন পর্ব খেলে পৌছাতে হয়েছিল মূল প্রতিযোগিতায়।

শুধু তাই নয়, অঘটনের বিশ্বকাপ শুরুই হয় নামিবিয়ার কাছে শ্রীলঙ্কার হার দিয়ে। তবে এত গেল কেবল একটা খেলার কথা, এরপর দুবারের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে প্রথম রাউন্ডেই বাইরে চলে যেতে হয় এবং সুপার ১২তে সেই ধারা অব্যাহত থাকে। 

কখনো আয়ার্ল্যান্ড ইংল্যান্ডকে হারায়, কখনও জিম্বাবোয়ে পাকিস্তানকে। আবার পাকিস্তান-বিজয়ী জিম্বাবোয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে ডাচদের কাছে। সেই নেদার্ল্যাণ্ডস  দলই সুপার ১২র স্তরের সবচেয়ে বড় চমকটা দিল শেষ দিনে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে। মনযোগী ক্রিকেট ভক্তের কাছে এ সবই চর্বিতচর্বণ, তাই এই ‘আপসেট উইন” গুলির বিশ্লেষণে যাব না এখানে। বরং ভারতের খেলার থেকে কয়েকটি উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে তথাকথিত ছোট ও বড় ক্রিকেট দেশগুলির মধ্যে ফারাক বেশ কিছুটা কমেছে।

ভারত তাদের গ্রুপের দুটি মিনো দলকেই সহজে হারিয়েছে। বরং সমস্যায় পড়েছে বাকি তিন তথাকথিত শক্তিশালী দলগুলির বিরুদ্ধেই। মিনো যাদের বললাম তারা যোগ্যতা অর্জন করে সুপার ১২এ খেলার সুযোগ পেয়েছিল।

দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে নতিস্বীকার করা ছাড়াও বিরাট কোহলির অভাবনীয় লড়াইএর মাধ্যমে হারা ম্যাচ জিতেছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশকে হারাতেও যথেষ্ট লড়াই করতে হয়েছে ভারতকে। 

কিন্তু সুপারস্টারে পরিপূর্ণ এই দলটি্র জিম্বাবোয়ে ও নেদারল্যান্ডস জয়েও কিছু মুহূর্তে ভারত সমস্যায় পড়েছিল।

নেদারল্যান্ডস ম্যাচে ভারত প্রথম ব্যাট করে ডাচ বোলারদের পরিণত লাইন এন্ড লেংথের জন্য খুব মন্থর গতিতে রান করতে শুরু করেন, বিশেষ করে পাওয়ারপ্লেতে। কে এল রাহুল আউট হয়ে যাওয়ার পর আগের খেলার নায়ক বিরাট ও অধিনায়ক রোহিতও প্রথমে রানের গতি বাড়াতে অক্ষম হন। এমন কী এই, খেলায় অর্ধ-শতরান করা রোহিতের একটি সহজ ক্যাচ মিড-অনে পড়ে যায়। ওটা ধরলে ভারতের ইনিংস আরও ফাঁপড়ে পড়ত এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।  

গ্রুপের শেষ খেলায় ভারতের ব্যাটিং আবার একটি ছোট গর্তে পড়ে যায় মিডল ওভার্সএ। বিশেষ করে রিশভ পন্থ লং অনে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যাওয়ার পর মনে হতে থাকে ভারত বড় রান খাড়া করতে পারবে না। তারপর অবশ্য এই মুহূর্তে পৃথিবীর সেরা টি২০ ব্যাটসম্যান সূর্য কুমার যাদব একটি যাদুবাস্তব ইনিংস খেলে ভারতকে দারুণ জায়গায় নিয়ে যান। (যাদুবাস্তব বললাম কারণ তাঁর কিছু শটে যাদু মিশেছিল যেমন, তেমনই তাঁর ফিল্ড রিডিং এবং শট সিলেকশনে বাস্তবতার ছাপ ছিল।)

এই ছোট বিশ্লেষণটি করার লক্ষ্য একটাই, উঠতি দেশ ও প্রতিষ্ঠিত দেশের মধ্যে স্তরের ফারাক আস্তে-আস্তে কমছে। এরকম উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই যেখানে ছোট দল বড় দলকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও বেগে ফেলেছে।

তাই এবারের বিশ্ব টি২০র এই অঘটনের জোয়ার যেন অক্ষুণ্ণ থাকে। এটাই যেন হয়ে ওঠে কুড়ি২০ বিশ্বকাপের টেমপ্লেট। তবে এর ফলে কী ক্রিকেটের সম্প্রাসারণ নিশ্চিত হয়ে গেল বা যাবে? মোটেই না। একটি দেশের ভূমিপুত্র/কন্যাদের মধ্যে খেলাটির প্রতি আগ্রহ জাগাতে না পারলে তা কোনদিনই সম্ভব না। তবে সেটি অন্য একটি লেখার বিষয়।