বছর কয়েক আগের একটি কথোপকথন। ২০২০র ১৭ আগস্ট তারিখে মুম্বাই অধিবাসী দ্বিতীয় বক্তা লিখেছিলেন একটি প্রথম শ্রেণীর ইংরেজী মিডিয়াম সংবাদপত্রে। কথোপকথনের স্থান ছিল দিল্লী, যেখানে প্রথম বক্তার ডেরা।
প্রথম বক্তা – “আয় ভাই। বুকে আয়। এখন তো আমরা ম্যান্ডেটরি ওভারে ব্যাট করছি জীবনের পিচে।হুট করে কবে খেলা শেষ হয়ে যাবে!”
দ্বিতীয় বক্তা – “অত সোজা না পার্টনার। আমাদের আর একটা সেঞ্চুরি পার্টনারশিপ হবে, দেখে নিও।”
প্রথম বক্তা – “সেঞ্চুরি টেঞ্চুরি তোমার জন্যই পার্টনার। আমার জন্য না।”
দ্বিতীয় বক্তা ঐ লেখাটিতে আফশোস করেছেন যে ১৯৮০-৮১র অস্ট্রেলিয়া সফরে ২ বার প্রথম বক্তার সেঞ্চুরি না পাবার কারণ ছিলেন তিনিই, একবার অ্যাডিলেডে পরোক্ষভাবে আর অন্যবার মেলবোর্নে প্রত্যক্ষভাবে। অ্যাডিলেডে পার্টনারের ৯৭ রানের সময়ে সতীর্থরা জোর করে তাকে ড্রেসিংরুম থেকে তুলে এনে প্লেয়ার’স এনক্লোজারে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরের বলেই লিলির শিকার হন প্রথম বক্তা। আর মেলবোর্নে দ্বিতীয় বক্তা-লিলি সংঘাত প্রসূত “ওয়াক আউট” এপিসোড ফোকাস নাড়িয়ে দিয়েছিল তার পার্টনারের।
সেঞ্চুরি না পাবার চিরস্থায়ী বেদনা নিয়ে প্রথম বক্তা বছরদুয়েক আগে চলে গেছেন না ফেরার দেশে, জীবনের একমাত্র ইনিংসে ৭৩ রান করে, আবারও একটা সেঞ্চুরি মিস করে। ১৬ আগস্ট ২০২০ তারিখে প্রথম বক্তা চেতন চৌহান প্রয়াত হয়েছিলেন গুরুগ্রামের একটি হাসপাতালে, করোনার বলে কিডনি ফেলিওরের হাতে ক্যাচ দিয়ে।
১৯৬৯-১৯৮১, এই ১২ বছরে ৪০টি টেস্ট আর ১৯৭৮-১৯৮১, এই ৩ বছরে ৭টি ওডিআই-তে ওপেনার হিসেবে তিনি ভারতীয় ব্লেজার গায়ে চড়িয়েছিলেন। ১৬টি অর্ধশতরানসহ তাঁর টেস্ট রান ছিল ২০৮৪ (গড় ৩১.৫৭), সর্বোচ্চ রান ছিল ৯৭।তাঁর ওডিআই রান ছিল ১৫৩। ২টি উইকেটও পেয়েছিলেন তিনি টেস্ট বোলার হিসেবে। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১৭৯টি ম্যাচ খেলে তাঁর রান ছিল এগারো হাজারেরও বেশী (১১১৪৩), যার মধ্যে ছিল ২১টি শতরান আর ৫৯টি অর্ধশতরান। মহারাষ্ট্র ও দিল্লির হয়ে রণজি ট্রফিতে আর পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের হয়ে দলীপ ট্রফিতে খেলেছিলেন চেতন চৌহান।
সিংহভাগ টেস্টে তার ওপেনিং জুটিতে সঙ্গী ছিলেন ওই মুম্বাইবাসী দ্বিতীয় বক্তা, যার নাম ছিল সুনীল মনোহর গাভাসকার। প্রায় দশ বছর ধরে তারা দুজনে জুটিতে নির্ভরযোগ্যতা দিয়েছিলেন ভারতকে। জুটিতে টেস্টে তাদের রানসংখ্যা ছিল ৩০০০য়ের বেশী। তাদের জুটিতে সর্বোচ্চ রান ছিল ২১৩। সোজা ব্যাটে খেলাই তাঁর বেশী পছন্দ ছিল।১৯৮০-৮১তে নিউজিল্যান্ডে জীবনের শেষ সিরিজের আগের সিরিজে অস্ট্রেলিয়ায় ৩ টেস্টে তাঁর সংগ্রহ ছিল ২৪৯ রান, অ্যাডিলেডের প্রথম ইনিংসের ৯৭ আর মেলবোর্নের দ্বিতীয় ইনিংসের ৮৫সহ।ওভালে ১৯৭৯ সালে ম্যচের শেষ ইনিংসে ৪৩৮ রানের টা্গট তাড়া করে ১ম উইকেটে ২১৩ রানের জুটি গড়েছিলেন চেতন চৌহান-সুনীল গাভাসকার।সে ইনিংসে ৮০ রান করেছিলেন চেতন চৌহান আর ২২১ রান করেছিলেন সুনীল গাভাসকার।
শতরান ছাড়াই ২০০০ রান করা প্রথম টেস্ট খেলোয়াড় ছিলেন চেতন চৌহান। জীবনের শেষ রণজি ম্যাচ ছিল মুম্বাইতে দিল্লীর হয়ে মুম্বাইর বিরুদ্ধে ১৯৮৪-৮৫র ফাইনাল খেলা।১-৬ এপ্রিল ১৯৮৫তে অনুষ্ঠিত ওই ম্যাচে পরাজত টিম দিল্লীর হয়ে ভাঙ্গা আঙুল নিয়েও ৯৮ আর ৫৪ রান করেছিলেন চেতন চৌহান।ওই ম্যাচেই ১২ উইকেট নিয়েছিলেন রবি শাস্ত্রী, দুই ইনিংসে ৪/৯১ আর ৮/৯১ বোলিং হিসেবের মাধ্যমে।
খেলা ছাড়ার পরে ডিডিসিএ-র বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন তিনি, সচিব সমেত। ২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক জয়ের সিরিজে তিনিই ছিলেন ভারতীয় দলের ম্যানেজার। দু’বারের জন্য লোকসভা সদস্য এবং দুবার ইউ পি-র মন্ত্রীও ছিলেন তিনি।
“সব পেলে নষ্ট জীবন”। তাই হয়ত তার ১৬টি অর্ধশত রান তাকে নিয়ে গিয়েছিল সর্বোচ্চ ৯৭ রান অবধি। টেস্ট শতরান আর পাওয়া হয়নি তার।ভারতীয় ক্রিকেট তাকে অবশ্য পেয়েছিল আস্থা যোগানো এক ওপেনার হিসেবেই। আর তিনি পেয়েছিলেন সহযোদ্ধা আর গুণমুগ্ধদের অকৃত্রিম আর অকুণ্ঠ ভালবাসা।
আপনিই শিখিয়ে গেছেন, একটুর জন্য কত কিছু হয়না। সব পাওয়ার আশা করা বোকামি, কিছু না পাওয়া অন্য কিছু পাওয়ার দরজা খুলে দেয় সব সময়। ভাল থাকবেন আপনি, চেতন চৌহান। ভারতীয় ক্রিকেট আপনাকে ভুলবে না।
আমাদের ক্রিকেট-কৈশোর সময়ের এক উজ্জ্বল তারা হিসেবে মনে থেকে যাবেন আপনি। আজ আপনার জন্মদিন।
জন্মদিনের প্রণাম, চেতন চৌহানকে।