এই বাজারেই অতঃপর একে একে এসে পড়া চার বিখ্যাত স্পিনারের। এঁদের মধ্যে বেঙ্কটরাঘবন ও বেদি সম্পর্কে কিছুটা জেনেছি আমরা ইতিমধ্যেই। তবে বেদি সম্পর্কীত আলোচনায় ওখানেই ইতি টানা মুশকিল।
বলে রাখি, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে বেদির অর্জনের (২১.৬৯ গড়ে ১,৫৬০-টি উইকেট) ধারেকাছেও আজ অবধি ঘেঁষতে পারেননি আর কোনও ভারতীয় বোলারই (তালিকার শীর্ষে বিরাজ করছেন ৪,২০৪-টি ফার্স্ট ক্লাস উইকেটের অধিপতি ইয়র্কশায়ার অর্থোডক্স উইলফ্রেড রোডস)। মনে রাখতে হবে, ইতিহাসের সেই পর্বে অস্তিত্বশীল হয়ে এই মাইলফলকে পৌঁছনো বেদির যেদিন স্রেফ টেস্টম্যাচের ভরসায় উপায় ছিল না খুব বেশি দূর এগোনোর। অবশ্যই ভারতীয় প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের খাতিরেও সম্ভব ছিল না এমন অভিজাত অর্জন। ৩৭০-টি প্রথম শ্রেণির খেলায় ১০৬ বার ইনিংসে পাঁচ (বা ততোধিক) উইকেট দখল করা বেদি দেশীয় অফ সিজনে খেলতে যেতেন নর্দাম্পটনশায়ারের হয়ে কাউন্টি ক্রিকেট।
সমসাময়িক ভারতীয় ক্রিকেটে বেদির মাহাত্ম্য মালুম হয় অন্যভাবেও। স্রেফ তাঁর সমকালে অস্তিত্ববান হওয়ার ভুলেই টেস্ট ক্যাপ পাওয়া হয়নি হরিয়ানভি রাজিন্দর গোয়েল ও মুম্বইকর পদ্মাকর শিভলকরের। যথাক্রমে ১৯৫৮-৫৯ থেকে ১৯৮৪-৮৫ পর্বে ১৮.৫৮ গড়ে ৭৫০ ও ১৯৬১-৬২ থেকে ১৯৮৭-৮৮ পর্বে ১৯.৬৯ গড়ে ৫৮৯-টি ফার্স্ট ক্লাস উইকেটের খাতিরেই চেনা যায় ঘরোয়া ক্রিকেটের যে দুই বাঘা অর্থোডক্সের জাত। এমনকি ১৯৭৯-৮০ থেকে ১৯৮৩-৮৪ পর্বে ৩৩ টেস্ট খেলা দিলীপ দোশিকেও বত্রিশ অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছিল টেস্ট ক্যাপ পেতে (তৎসত্ত্বেও ১১৪-টি টেস্ট উইকেট অর্জনেই স্পষ্ট যাঁর মহিমা)। দেশীয় ক্রিকেটে বাংলা ও সৌরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করা এই অর্থোডক্সের জন্ম ডিসেম্বর ২২, ১৯৪৭-এ রাজকোটে।
মে ২২, ১৯৪০। ব্যাঙ্গালোরে জন্ম ১৯৬১-৬২ থেকে ১৯৭৮-৭৯ অধ্যায়ে ৪৯ টেস্ট খেলা কর্ণাটকি অফস্পিনার এরাপল্লি প্রসন্নর। মাঠে নেমে ব্যাট-বল ঠেঙানোর (অবশ্যই ক্রিকেট বলে) অভিজ্ঞতা যাঁর আছে জানবেন স্পিনারের হস্তশিল্পের ঋদ্ধতার একটা আঁচ মেলে হাত থেকে নির্গমন মুহূর্তে বল হাওয়ায় কতটা ‘সরররর’ আওয়াজ তুলে কাটতে পারছে তার উপর। প্রসন্নর বেলায় শব্দটা শোনা যেত সেই সিলি পয়েন্ট থেকে। তবুও চার বিখ্যাত স্পিনারের মধ্যে ঘটনাচক্রে সব চাইতে কম টেস্ট তিনিই খেলেছিলেন। যার বড় কারণটা অবশ্যই ১৯৬১-৬২ পরবর্তী বেশ ক’ বছর স্বেচ্ছায় বাইশ গজ থেকে সরে থাকা। স্নাতক স্তরের পড়াশুনো সম্পূর্ণ করার তাগিদে।
মে ১৭, ১৯৪৫। মহীশূরে জন্ম ১৯৬৩-৬৪ থেকে ১৯৭৯ পর্বে ৫৮ টেস্ট খেলা কর্ণাটকি লেগস্পিনার ভগবৎ চন্দ্রশেখরের। শৈশবে ডানহাত পোলিয়োয় আক্রান্ত হওয়ার দরুণ মারণ ডেলিভারিগুলির কোনটি কোনদিকে বাঁক নেবে মাঝেমধ্যে টের পেতেন না চন্দ্র নিজেও। এমনিতেও ফিঙ্গার স্পিনারের তুলনায় পিচের সহায়তা কমই দরকার পড়ে রিস্ট স্পিনারের। উপরন্তু কার্যকারিতার প্রশ্নে বাকি তিনের চাইতে চন্দ্রের বরাবরই অধিনায়কের বেশি প্রিয়পাত্র থাকতে পারার হেতু টের পাওয়া যাবে তাঁর স্ট্রাইক রেটের (৬৫.৯) দিকে তাকালেই। প্রসন্ন, বেদি ও বেঙ্কটরাঘবনের বেলায় যা যথাক্রমে ৭৫.৯, ৮০.৩ ও ৯৫.৩।
কিন্তু ফাস্ট বোলারের যতই আকাল থাকুক, স্যুইংনির্ভর প্রতিভাবান পেসাররা কি অতটাও বিরল হয়ে পড়েছিলেন সেদিন দেশে? অবশ্যই নয়। ঘটনা হল, টাইগারের ছকে মানানসই না হতে পারার মূল্য দিতে হয়েছিল তাঁদের। বার্মিংহামে স্যুইং-এর অতি আদর্শ পরিবেশে নতুন বল হাতে দৌড়তে শুরু করছেন বুধি কুন্দরন এবং রিজার্ভ বেঞ্চে বসে রয়েছেন দুই বিশেষজ্ঞ পেসার বাঙালি সুব্রত গুহ ও মারাঠি সদানন্দ মহল (এঁর ভাগ্যে লেখা ছিল না টেস্ট ক্যাপ)। এমন দৃশ্যও রচিত হয়েছে সেকালে।
১৯৫৮-৫৯ থেকে ১৯৬৪-৬৫ পর্বে মাত্র ৭ টেস্টেই থমকে যায় মারাঠি পেসার বসন্ত রঞ্জনের (জন্ম জুলাই ২২, ১৯৩৭-এ পুণায়) কেরিয়ার। তার মধ্যেও দীর্ঘ স্পেলে হাত ঘোরানোর সুযোগ কমই হয়েছে বলকে সমান দক্ষতায় দু’ দিকেই স্যুইং করাতে পারা প্রতিভাবান রঞ্জনের। বলে রাখি, জুলাই ২২, ১৯২০-তে সাগরে জন্ম ১৯৪৬ থেকে ১৯৫১-৫২ পর্বে ৯ টেস্ট খেলা অলরাউন্ডার চাঁদু সারভাতেরও। প্রসঙ্গত, ১৯৪৬-এর ইংল্যান্ড সফরে সারে কাউন্টির বিরুদ্ধে দশম উইকেট জুটিতে এঁর ও শুঁটে ব্যানার্জির জোড়া শতরান হাঁকানোর ঘটনাটি পৌঁনে শতাব্দী পরও আজও ফেরে ক্রিকেট-রসিকদের মুখে মুখে।
১৯৫৯-এর ইংল্যান্ড সফরে টেস্টম্যাচগুলির বোলিং গড়ে ভারতীয়দের মধ্যে সবার আগে থাকা রামন সুরেন্দ্রনাথের (জন্ম জানুয়ারি ৪, ১৯৩৭-এ মীরাটে) কেরিয়ারও ১১ টেস্টেই (১৯৫৮-৫৯ থেকে ১৯৬০-৬১ পর্বে) থেমে যাওয়ার কথা ছিল না। বিশেষত বিলেতের আবহাওয়ায় দলের লোভনীয় সম্পদ হিসেবেই বিবেচিত হতে পারতেন এই সার্ভিসেস পেসার।
প্রথম শ্রেণিতে ২১.৮৯ গড়ে ৩৩৭-টি উইকেট অর্জন করা পূর্বোক্ত রাজিন্দর পালের বরাতেও লেখা ছিল একটাই টেস্ট।
৪ টেস্ট খেলা সুব্রত গুহর খতিয়ান টেস্ট ক্রিকেটের আসরে যথেষ্টই হতাশাজনক হলেও (১০৩.৬৬ গড়ে সংগ্রহ মাত্র ৩-টি উইকেট) ২০.২৯ গড়ে ২৯৯-টি ফার্স্ট ক্লাস উইকেটের অধিপতি এই বাঙালি পেসারের বেলায় পল্লবিত হয়েছে কিছু কিছু গোপন অন্তর্ঘাতের কাহিনি।
বাঁ-হাতি উমেশ কুলকার্নি যদিও ঘরোয়া ক্রিকেটের আসর থেকেও হারিয়ে যান ক্যালেন্ডারের পাতা সাতের দশক ছোঁয়ার আগেই।