প্রসন্ন@৮৩

সে এক সময়। বছরে একটির বেশী সিরিজ হত খুব কম। একটি সিরিজে তিনটি বা চারটির বেশী টেস্ট হলে সেটা ব্যতিক্রম হিসেবেই গণ্য হত তখন। এবং তখন অত্যন্ত বেশী রকমের স্পিন-নির্ভর ছিল চারজন “কোয়ালিটি স্পিনার” সমৃদ্ধ ভারতীয় ক্রিকেট। চার স্পিনারের মধ্যে কাউকে না খেলানো এবং তাদের মধ্যে কে মাঠের বাইরে বসবেন, সেটা ঠিক করে ফেলা তখন খুব কঠিন কাজ ছিল ভারতীয় নির্বাচকদের জন্য এবং একটি টেস্ট ছাড়া (একটি মাত্র টেস্টেই চারজন খেলেছিলেন একসঙ্গে) এই দায়িত্ব তাঁরা পালন করেছেন দক্ষতার সঙ্গে। সত্তরের দশকে এমনও দেখা যেত, একদিকে বোলিং ওপেন করতেও ডাক পেতেন কোনও এক স্পিনার। এবং প্রথম দশ ওভার খেলার মধ্যেই অবশ্যম্ভাবীভাবে দু’দিকের বোলিং দায়িত্বে এসে যেতেন দুই স্পিনার। আর এ ভাবেই নিয়মিত হারতে থাকা দলটাকে আস্তে আস্তে জয়ের সরণীতে উঠে পড়তে অভ্যস্ত করে তুলেছিলেন ওই “স্পিন চতুষ্টয়”, যাঁদের একসঙ্গে ডাকা হত প্রসন্ন-বেদী-চন্দ্র-ভেঙ্কট নামে।

সেইরকম এক সময়ে প্রায় ১৭ বছরের কেরিয়ারে মাত্র ৪৯টি টেস্ট খেলেছিলেন তিনি, ওই চার স্পিনারের একজন। অবশ্য ওই ১৭ বছরের মধ্যে ৫ বছর, ১৯৬২-১৯৬৩ থেকে ১৯৬৬-৬৭ তাঁকে টিমের বাইরে থাকতে হয়েছিল, স্নাতক-স্তরের পড়াশোনার কারণে। ১০ জানুয়ারি ১৯৬২ তারিখে তিনি প্রথম টেস্ট খেলেন মাদ্রাজে, ১৯৬১-৬২-র ভারত বনাম ইংল্যান্ড সিরিজের ৫ম ও শেষ ম্যাচে। পেয়েছিলেন ১টি মাত্র উইকেট, ব্যাটে করেছিলেন অপরাজিত ৯ ও ১৭ রান। তবু পরের ৫ টেস্টের বিদেশী সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজগামী বিমানে জায়গা হয়েছিল তাঁর। ১ম টেস্টে বাদ। ২য় টেস্টে ৬ ও অপরাজিত ১ রান এবং ১২২ রানে ৩ উইকেট, যার মধ্যে ছিল রোহন কানহাইর উইকেটও। তারপরে বাকি ৩টে টেস্টে আবার বাদ যান তিনি। এবং ০-৫ ম্যাচে হেরে আসা ওই সিরিজের পরের ৫ বছরের জন্য তাঁর টিমে ঢোকার দরজা বন্ধ ছিল। ওই অবস্থায় অন্য কেউ হলে হয়ত ২ টেস্টে ৪ উইকেটেই তার কেরিয়ার শেষ হয়ে যেত। কিন্তু তিনি ছিলে অন্য ধাতের। ওই ৫ বছরে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী করে নেন তিনি, তাঁর অধ্যয়ন দক্ষতায়। শোনা যায় যে তিনি স্বেচ্ছায় নিজেকে টিম থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন পড়াশোনার জন্য – “Pras decided to finish his undergraduate studies, and was absent from the Test scene for five years.” [https://www.espncricinfo.com/player/erapalli-prasanna-32357], বা “He left the sport for a period to finish his engineering degree, returning in 1967.” [https://en.wikipedia.org/wiki/E._A._S._Prasanna]; যাই হোক, তিনি টিমে ফেরেন ১৩ জানুয়ারি ১৯৬৭ তারিখে মাদ্রাজে, ১৯৬৬-৬৭-র ভারত বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের ৩য় ও শেষ ম্যাচে। বোলিংয়ে পেয়েছিলেন ২-১১৮ (বুচার ও হল) ও ৩-১০৬ (হান্ট, বুচার, হেন্ড্রিক্স), ব্যাটে করেছিলেন ১ ও ২৪ রান। ১৯৬৭-র ইংল্যান্ড সফরে ৯ উইকেট নেন ৩ টেস্টে। লাহোরের গদ্দাফি স্টেডিয়ামে ২৭ অক্টোবর ১৯৭৮ তারিখে শেষ টেস্ট খেলতে নামা অবধি  আর পিছনে তাকাতে হয়নি তাঁকে এরপরে।

৪৯ টেস্টে ১৮৯ উইকেট, যার মধ্যে ইনিংসে ৫ উইকেট ছিল  ১০ বার আর ম্যাচে ১০ উইকেট ছিল  ২ বার। সেরা বোলিং ছিল ৮/৭৬ আর ১১/১৪০, ইনিংস আর ম্যাচে, যথাক্রমে। ৩০.৩৮ ছিল উইকেটপ্রতি রানের গড় এবং ২.৪০ ছিল তার ওভারপ্রতি ইকনমি রেট।। ২০ টেস্টে ১০০ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি, যা ছিল তখন ভারতীয় বোলারদের মধ্যে দ্রুততম এবং পরে যা ভেঙ্গে দেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। তাঁর সময়ে তিনি ছিলেন ভারতের তো বটেই, ক্রিকেট দুনিয়ারও অন্যতম এক সেরা অফস্পিনার। দ্রুতগতিতে করা হাই অ্যাকশনের সঙ্গে বলের লাইন আর লেংথের উপর নিখুঁত নিয়ন্ত্রণ ছিল তাঁর। উঁচু ফ্লাইট তাঁর বলে বাউন্স এনে দিত স্বতস্ফুর্তভাবেই। মাঝে মাঝে বড়মাপের বল ঘোরালেও স্পিনের চেয়েও বেশী ঘাতক ছিল তাঁর ফ্লাইটের হেরফের। হাওয়ায় ব্যাটসম্যানদের ভুল করাতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। এবং তাঁর বলের ফ্লাইটের হেরফেরে বিভ্রান্ত ব্যাটসম্যানরা মন্ত্রমুগ্ধের মত উইকেট দিয়ে যেতেন তাঁকে। বড় মাপের না হলেও তাঁর ব্যাট মাঝে মাঝে বিপক্ষের বোলিংয়ের সামনে দেওয়াল তুলে দিয়ে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের “লেজ”কে স্বাভাবিক দৈর্ঘ্য থেকে সাময়িকভাবে আংশিক মুক্তি দিত। ৪৯ টেস্টে ১১.৪৮ গড়ে তাঁর মোট রান ছিল ৭৩৫ (সর্বোচ্চ ৩৭)। তাঁর অধিনায়কত্বে ২ বার রণজি ট্রফি জিতেছিল কর্ণাটক।

তাঁকে ভারতীয় ক্রিকেট চিনত এরাপল্লী অনন্তরাও শ্রীনিবাস প্রসন্ন বা সংক্ষেপে এরাপল্লী প্রসন্ন নামে। তাঁর আত্মজীবনীর নাম “ওয়ান মোর ওভার”। তাঁর বলের উচ্ছসিত প্রশংসা করতেন ইয়ান চ্যাপেল এবং তাঁকে ডাকতেন “ইঞ্জিনিয়ার অফ স্পিনিং” নামে। শেন ওয়ার্নকে এরাপল্লী প্রসন্নর সাথে পরিচয় করাতে গিয়ে তিনি ওয়ার্নকে বলেছিলেন “Son, you’re talking to one of the greatest spinners ever”. বিষাণ বেদীর মত স্পিন, ভাগবৎ চন্দ্রশেখরের মত গতি আর শ্রীনিবাস ভেঙ্কটরাঘবনের মত অল-রাউন্ড দক্ষতা না থাকলেও ভারতীয় ক্রিকেটে চিরদিন এক সশ্রদ্ধ পূজনীয় চরিত্র হয়েই থেকে গেছেন তিনি, এরাপল্লী প্রসন্ন। 

আজ তাঁর ৮৩তম জন্মদিন।

শুভ জন্মদিন, ১৯৭০-এর পদ্মশ্রী পুরস্কার, ২০০৬-এর ক্যাস্ট্রোল লাইফটাইম পুরস্কার পাওয়া এবং কলকাতার জামাই এরাপল্লী অনন্তরাও শ্রীনিবাস প্রসন্ন ।🙏🙏