প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের একটি বিশেষ গুণ থাকে। জটিল থেকে জটিলতর বিষয়কে সহজ প্রাঞ্জল ভাষায় বোঝানোর ক্ষমতা। একজন সাধারণ মানুষ এমন কি একটি শিশুও যা শুনে বা পড়ে বিষয়টি অনুধাবন এবং প্রণিধান করতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবন্ধে আমরা এই বিষয়টি লক্ষ্য করে থাকি। কবীর সুমন যখন সঙ্গীতের কোনও বিষয়কে অনুষ্ঠানে বোঝান, ঠিক এমনই সহজ ভাষায় বলেন। ক্রিকেট খেলার টেকনিকালিটির মতো একটি জটিল বিষয়কে বাংলার অন্যতম সেরা ক্রিকেটার এবং প্রাজ্ঞ কোচ গোপাল বসু এমনই সহজ ভাষায় বুঝিয়েছেন “এসো ক্রিকেট খেলি” বইয়ে।
বইটির উৎসর্গ-পত্রে শ্রী বসু লিখেছেন, “স্কুলের ব্যাগের কাছেই যারা ব্যাট-বল গুছিয়ে রাখছে সেই সব ছোট্ট বন্ধুদের জন্য”। অর্থাৎ ‘টার্গেট অডিয়েন্স’ তিনি নির্ধারণ করছেন শিশু, বালক-বালিকা, কিশোর-কিশোরীদের। পুরো ঊনআশি পাতার বইতে তিনি পাঠককে তুমি সম্বোধন করে গল্পের ছলে বোঝালেন ক্রিকেটের ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিংয়ের খুঁটিনাটি।
বইটির প্রথম পর্বে ব্যাটিং। শ্রী বসু শুরু করেছেন ব্যাট ধরা থেকে। অর্থাৎ, একটি ব্যাটকে মাটিতে রেখে কুড়ুলের মতো তুলে কিভাবে ধরতে হবে। সফ্ট হ্যান্ডের মতো বিষয়, যা গাভাস্কারের বেঙ্গালুরুর ৯৬ রানের মহাকাব্যের মূল মন্ত্র ছিল, তা বোঝালেন সহজ ভাষায়। এরপর ক্রমে-ক্রমে কিভাবে সট্যান্স নিতে হবে, ব্যাক লিফ্টের সময় ব্যাট কিভাবে উঠবে তা নিয়ে গল্প করলেন তিনি। এরপর প্রথমেই ব্যাক-ফুটের শটগুলি এলো। স্কোয়্যার-কাট এবং লেট-কাটের সময় বলের অবস্থান, পিছনের পায়ের স্থান পরিবর্তন, ব্যাটের সরণ বোঝালেন। পুল এবং হুকের পার্থক্য বোঝালেন। ড্রাইভের মধ্যেও অফ-ড্রাইভ, স্কোয়্যার-ড্রাইভ, কভার-ড্রাইভের তফাত আলোচনা করলেন।
রান নেওয়ার সময় প্রথম রান দ্রুত নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করলেন। স্মর্তব্য, এই বইয়ের প্রথম প্রকাশ ১৯৯০ সালে। সেই সময় গোপাল বসু বলছেন, একটা রান দ্রুত নেওয়ার কথা, যাতে চাপে পড়ে ফিল্ডার বল গলিয়ে দেয় এবং আরেকটি রান নেওয়ার সময় এবং সুযোগ পাওয়া যায়। মনে পড়ল, গোপাল বসু চলে যাওয়ার পর সৌরাংশুদা অবিচুয়ারি লেখার সময় বলেছিলেন, আশির দশকে শ্রী বসু ‘রান আ বল’ থিওরির কথা বলেছিলেন এবং সঙ্গে বলেছিলেন, সেই যুগে শ্রী বসু পরামর্শ দিয়েছিলেন, শুধুমাত্র ব্যাটিং বা বোলিং দিয়ে চলবেনা। অলরাউন্ডার বা পার্ট-টাইম হলেও তা প্রয়োজন।
এবার আসি বোলিংয়ে। শুরুতেই শ্রী বসু বল এবং বলের সেলাই অর্থাৎ সিম বুঝিয়েছেন। একেবারে গোড়ার কথা। এরপর পেস বোলিং সম্পর্কে আলোচনা করার সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন – জোরে বল শীতের সকালের মতো। একটু পরে ঠাণ্ডা সয়ে যায়। ব্যাটসম্যানও কিছুক্ষণ পর জোরে বল বুঝতে পারেন। অতএব স্যুইং সর্বত্র কার্যকরী। এরপর তিনি প্রবেশ করলেন স্য়ুইংয়ে। ইন-স্যুইং, আউট- স্যুইং, অফ-কাটার, লেগ-কাটার বোঝানোর পর তিনি প্রবেশ করলেন স্পিন বোলিংয়ে।
লেগ-স্পিনের ক্ষেত্রে ফ্লিপার, লেগ-ব্রেক, গুগলির তফাত বোঝালেন, অফ-স্পিন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলেন।
এরপর আসল ম্যাজিক। আসলে গোপাল বসু নামের অর্থ মনীষা এবং প্রজ্ঞার তুরীয়তা। তিনি ফিল্ডিং এবং উইকেট কিপিং নিয়েও ক্লাস নিলেন। কিপারের বল ধরার সময় হাতের পজিশান বোঝালেন। বোঝালেন উইকেট রক্ষকের ফুটওয়ার্ক। ফিল্ডারের অ্যান্টিসিপেশান। যা পরবর্তীকালে জন্টি রোডস বলতেন।
এবং অবশ্যই অধিনায়কত্ব। এই প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ভালো ক্রিকেটার হওয়ার চেষ্টা করার অর্থ হচ্ছে ভদ্রলোকের মতো আচরণ করা। ফিল্ড প্লেসিং, অনুমান ক্ষমতা এবং দল এবং প্রতিটি খেলোয়াড়ের ওজন বোঝার পরামর্শ দিলেন শ্রী বসু।
আর শেষ পাতে? শ্রম, শ্রম এবং শ্রম। নেটে ঘাম ঝরানো এবং ভাবনা চিন্তার বিকল্প আর কিছুই নেই, তা আবারও স্মরণ করালেন শ্রী বসু।
গোপাল বসুর ন্যায় ক্রিকেট প্রজ্ঞা ভূভারতে বিরল। বাজারের বাইরে থেকেও ক্রিকেট যাপন বোধ হয় এমন মানুষের পক্ষেই সম্ভব। মনে পড়ছে, বইমেলায় এক নবীন সহনাগরিক ক্রিকেট বোঝার বা খেলার জন্য কি বই কেনা উচিত জিজ্ঞাসা করায় সৌরাংশুদা তাঁকে পরামর্শ দেন, “’আজকাল’-এ যাও, গোপালদার ‘এসো, ক্রিকেট খেলি’ বইটা কেনো এবং পড়ো”। গোপাল বসু ক্রিকেটের দ্রোণাচার্য্য। আর “এসো, ক্রিকেট খেলি” তাঁর অস্ত্র শিক্ষার পুঁথি।
বই: এসো ক্রিকেট খেলি
লেখক: গোপাল বসু
প্রকাশক: আজকাল
মূল্য: ২৫ টাকা