ক্রিকেটের এক বিস্ময়বিজ্ঞানীর হারিয়ে যাওয়ার ১৫ বছর পার হয়ে গেছে মাস দুয়েক আগেই। তাঁর জন্মদিন ছিল ১৪ মে ১৯৪৮। তাঁর জন্ম হয়েছিল কানপুরের জর্জিনা ম্যাকরবার্ট মেমোরিয়াল হাসপাতালে, যার অদূরেই ছিল গ্রীন পার্ক স্টেডিয়াম। সেদিন থেকে তাঁর অকালমৃত্যুর দিন ১৮ মার্চ ২০০৭, এই ৫৯ বছরের ব্যাপ্তিতে তাঁকে কখনোই বাঁধা যায় না। তাঁর নাম ছিল রবার্ট অ্যান্ড্রু উলমার।
বিশ্বনাগরিক ছাড়া আর কোন সংজ্ঞায় তাঁকে বর্ণনা করা অসম্ভব। তাঁর জন্ম হয়েছিল ভারতে, তিনি জীবন কাটিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকায়, খেলেছেন ইংল্যান্ডের হয়ে, কোচিং করিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকা আর পাকিস্তান টিমকে, আর তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে।
বিশ্বনাগরিক এই ক্রিকেটপ্রতিভার জন্ম হয়েছিলো ভারতের কানপুরে, তাই কি রোমান্টিসিজম ঘিরে ছিলো তাঁর খেলোয়াড় আর কোচিং জীবন জুড়ে? হয়ত এই রোমান্টিসিজমই ব্যাখ্যা করে তাঁর “কেন্টময়” প্রথম শ্রেণীর ম্যাচগুলো বা তাঁর কোচিংয়ে আমূল-পরিবর্তিত দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দলকে, বিশেষত ফিল্ডিংয়ে।
হয়ত এই রোমান্টিসিজমই তাঁর ক্রিকেট কেরিয়ারে মাত্র ১৯টি টেস্ট (৩১ জুলাই ১৯৭৫ থেকে ২ জুলাই ১৯৮১) খেলায় ডান হাতের ব্যাটিংয়ে ১,০৫৯ রান, ৩টি টেস্ট শতরান (সর্বোচ্চ ওভালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ১৯৭৫-এর অ্যাশেজ সিরিজে ১৪৯) আর ২টি অর্ধশতরান, বা ২৪ আগস্ট ১৯৭২ থেকে ২৮ আগস্ট ১৯৭৬ পর্যন্ত সীমায়িত তাঁর মাত্র ৬ ম্যাচের শোচনীয় ওডিআই পারফরমেন্সকে (মোট ২১ রান) গুরুত্বহীন করে দেয়। ডান হাতের মিডিয়াম-পেসে ৪টি টেস্ট উইকেট আর ৯টি ওডিআই উইকেটও ছিলো তাঁর ক্রিকেট কিটিতে।
তাঁর রোমান্টিক ক্রিকেট প্রতিভা অবশ্য সযত্নে রক্ষিত আছে তাঁর প্রথম শ্রেণীর কেরিয়ারের মোড়কে, যেখানে ধরা আছে ৩৫০ ম্যাচে ৩৪টি শতরান আর ৭১টি অর্ধশতরানে মোড়া ঝকঝকে ১৫,৭৭২ রান এবং বোলিংয়ে অর্জিত ৪২০ উইকেট। ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্রিকেটে তিনি খেলেছিলেন কেন্ট (১৯৬৮-৬৯ থেকে ১৯৭২-৭৩, ১৯৭৬-৭৭ থেকে ১৯৭৯-৮০, ১৯৮১-৮২ থেকে ১৯৮৪-৮৫) কাউন্টির হয়ে, আর দক্ষিণ আফ্রিকায় নাটাল (১৯৭৩-৭৪ থেকে ১৯৭৫-৭৬) আর ওয়েস্টার্ণ প্রভিন্সের (১৯৮০-৮১) হয়ে। ২০ বছরের উলমার ১৯৬৮ সালে এসেক্সের বিরুদ্ধে তাঁর কেন্ট-জীবন শুরু করেছিলেন।
কাউন্টির হয়ে সফল অলরাউন্ডার তিনি এমসিসি-র হয়ে সফরকারী অস্ট্রেলিয়া দলের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করেছিলেন তাঁর ফাস্ট-মিডিয়াম বোলিংয়ের বৈচিত্র্যে। এর সুবাদে ১৯৭৫ অ্যাসেজ সিরিজে অস্ট্রেলিয়া দলের বিরুদ্ধে লর্ডসে দ্বিতীয় টেস্টে (যে টেস্ট ২য় ইনিংসে জন এডরিচের ১৭৫ রানের জন্য আজও বিখ্যাত) সুযোগ পাওয়া, ৩১ জুলাই ১৯৭৫ তারিখে। ব্যাটে রান করেন ৩৩ ও ৩১ (দু ইনিংসেই আউট হন অ্যাশলে ম্যালেটের বলে), বোলিংয়ের হিসেব ছিল ১/৩১ ও ০/৩, ম্যাচ ড্র হয়। তখন অস্ট্রেলিয়ার বোলিং সামলাতেন লিলি-টমসন-ওয়াকার-ম্যালেটরা। পরের টেস্টে বাদ পড়ে সিরিজের ৪র্থ ও শেষ টেস্টে টিমে ফেরেন ওভালে। ১ম ইনিংসে ৫ রানে আউট হলেও ২য় ইনিংসে করেন ১৪৯, তাঁর জীবনের প্রথম টেস্ট শতরান, যা ছিল টেস্টে তাঁর সর্বোচ্চ রান। তাঁর বাকি ২টি টেস্ট শতরানও ছিল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেই, ১৯৭৭-এ। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬, ইংল্যান্ড ওডিআই দলে সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি।
১৯৭০-৭১-এই ২২ বছর বয়সে তাঁর কোচিং কেরিয়ার শুরু হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায় এবং ১৯৭৫-এ প্রথম টেস্ট খেলার আগেই তিনি কেন্টের এক প্রিপারেটরি স্কুলে শারীরবিদ্যার শিক্ষক হিসেবে চাকুরীরত ছিলেন। এ ছাড়া নিজের ক্রিকেট স্কুলও চালাতেন তিনি। আজকের রিভার্স সুইপকে তাঁর কোচিংয়ের অবদান বলে মানেন অনেকে। দু’দিকে ডাইভ, ফিস্ট সহ ফুটবলের গোলরক্ষকের বহু গুণ ক্রিকেটের উইকেট-রক্ষকের মধ্যে জারিত করায় জোর দিতেন তিনি।
১৯৮৪-তে ক্রিকেট খেলা শেষ হবার পরে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় মাইগ্রেট করেন, সেখানের স্কুলে ক্রিকেট ও হকি শেখাতে থাকেন। ১৯৮৭তে ইংল্যান্ডে ফিরে কেন্টের ২য় একাদশের কোচ হন। ১৯৯১-তে হন ওয়ারউইকশায়ার টিমের কোচ যারা তাঁর কোচিংয়ে ১৯৯৩-এর ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি জেতে। এবং ১৯৯৪ থেকে দীর্ঘ সময় দক্ষিণ আফ্রিকার কোচের দায়িত্ব সামলান। প্রথম সিরিজে ভালো ফল না হলেও পরের ১৫টির মধ্যে ১০টি সিরিজ জিতেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ১৯৯৬ ও ১৯৯৯ বিশ্বকাপে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার কোচ ছিলেন, যদিও দু’বারই ব্যর্থ হয়েছিল তাঁর দল। মাঠের কমিউনিকেশন সিস্টেমে “বিপ্লব” এনে তিনি ও অধিনায়ক হ্যান্সি ক্রোনিয়ে ইয়ারফোন ব্যবহার করেন ১৯৯৯ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে। এরপর সাময়িক বিরতি নিতে তিনি ফিরেছিলেন ওয়ারউইকশায়ারে, তবে অন্য ভূমিকায়।
২০০৪ থেকে জীবনের শেষ তিন বছর পাকিস্তানের কোচ ছিলেন তিনি। তাঁর কোচিংয়ে আয়ার্ল্যান্ডের কাছে হেরে পাকিস্তান দল ছিটকে গিয়েছিল ২০০৭-এর বিশ্বকাপ থেকে। দিনটা ছিল পনের বছর আগের ১৮ মার্চ। আর ওই দিনই জামাইকার কিংস্টনের পেগাসাস হোটেল থেকে উদ্ধার করা হয় পাকিস্তানের কোচ রবার্ট অ্যান্ড্রু উলমারের মৃতদেহ। তার চার দিন পরে তদন্ত শুরু হয়েছিলো তাঁর অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে। ওই ২০০৭য়েরই নভেম্বরে তাঁর মৃত্যুর তদন্তে দাঁড়ি পড়ে যায়, জামাইকার “জুরী”-র ওপেন ভার্ডিক্টে।
তাই আজও অজানা তাঁর মৃত্যুর কারণ। মৃত্যুতেও রোমান্টিকই থেকে গেছেন রবার্ট অ্যান্ড্রু উলমার, যাঁকে আমরা চিনতাম ইংল্যান্ডের বব উলমার নামে। তাঁর বিদায়ে দরিদ্র হয়েছে বিশ্ব ক্রিকেট। বেঁচে থাকলে আজ তিনি ৭৪ পূর্ণ করে ৭৫য়ে পা দিতেন।
শুভ জন্মদিন, বিশ্বনাগরিক ক্রিকেটবিজ্ঞানী।