আচ্ছা, আপনারা “ছক-টেস্ট” খেলেছেন, বা “Book Cricket”? অবশ্যই খেলেছেন, আপনারা সবাই না খেললেও অনেকেই হয়ত ছোটবেলায় খেলেছেন – মনে পড়ছে না? কাগজ-কলম আর লুডোর ছক্কা বা মোটাসোটা একটা বই নিয়ে – মনে পড়েছে তো! আসুন তাহলে এক অন্য ধরণের, ঘরে-বসে কাগজে-কলমে ক্রিকেট-ম্যাচ (Paper Cricket) খেলার গল্পটা বলি। আশা করি নেহাৎ মন্দ লাগবেনা। তবে মনে রাখবেন এসব হচ্ছে ষাটের দশকের শেষের দিকের ‘প্রায়-প্রাগৈতিহাসিক’ যুগের কথা – ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে!
“ছক-টেস্ট” খেলা হ’ত লুডোর ছক্কায় দান দিয়ে – ‘১’, ‘২’, ‘৩’, ‘৪’, ‘৬’ – যেমন পড়বে তত রান, আর ‘৫’ পড়লে আউট, “ডট-বল”-এর বালাই নেই (টি২০-style?) – আমি অনেক খেলেছি, বিশেষত ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে, স্কুলের গরমের বা পূজোর বা বড়দিনের ছুটিতেই বেশি, যখন হাতে সময় থাকত অথচ বাড়ির বাইরে খেলতে যাওয়ার সুযোগ থাকতনা, অর্থাৎ দুপুরবেলায়, খাওয়াদাওয়ার পর।
“Dream-11”-র মতন একাধিক দল বানাতাম। আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল “Alphabet XI”, অর্থাৎ দলের প্রতিটা খেলোয়াড়ের নাম (আসলে পদবী) ‘A’ দিয়ে শুরু হ’লে “A-Team” (যেমন অ্যাডকক, অধিকারী, আমেদ, অমরনাথ, ইত্যাদি); ‘B’ দিয়ে শুরু হ’লে “B-Team” (যেমন ব্যারিংটন, বোরদে, ব্র্যাডম্যান, ব্রাউন, ইত্যাদি) – এইরকম আর কি! এইসব খেলতে খেলতে অত কমবয়সেই দেশ-বিদেশের অনেক ক্রিকেটারের নাম (এবং অনেকেরই মূল ভূমিকাটা – ব্যাটার না বোলার না উইকেট-কিপার) জেনে গেছিলাম। আপনারাও কয়েকটা ‘বর্ণমালা একাদশ’ – ইন্টারনেট না হাতড়ে – বানিয়ে দেখুন, মজা পাবেন; না পারলে Google-বাবা তো আছেনই!
দল বানাতে গিয়ে আটকে গেলে বা ঠেকায় পড়লে বাবা-কাকা-জ্যাঠা-মামা-পিসে-মেসো জাতীয় গুরুজনরা বা বয়সে বড় তুতো-দাদারা এঁরা ছিলেন ভরসা। তবে তাঁদের কাজের দিনে দুপুরবেলায় পাওয়া মুশকল ছিল, তাই দল নির্বাচন পর্বটা সন্ধেবেলাতেই কোনও এক ফাঁকে, হয়ত রাতে খাওয়ার সময়, সেরে রাখতে হ’ত। দলের তালিকাগুলো যত্ন করে গোটা গোটা অক্ষরে, অনেক সময় ভুল বানানে, লিখে রাখতাম।
আর এই একইরকম দল বানিয়ে খেলতাম “Book Cricket” – একটা মোটাসোটা বই [বাড়িতে তখন টেলিফোন ছিলনা অতএব Telephone Directory-ও নেই, আমার পছন্দের বই ছিল বাবার ইয়া মোটা এক আশুতোষ দেব প্রণীত English-to-Bengali Dictionary] নিয়ে তার পাতা উল্টে ডানদিকের পৃষ্ঠাসংখ্যার একদম ডানদিকের অঙ্কটা (digit) যদি ‘১’, ‘২’, ‘৩’, ‘৪’, ‘৬’ আসে, তবে তত রান আর ‘০’ এলে আউট – বাকি চারটে সংখ্যা (অর্থাৎ ‘৫’, ‘৭’, ‘৮’, ‘৯’) এলে ‘dot-ball’ – এই ছিল আমার খেলার নিয়ম, তবে অন্যরকম নিয়মও ছিল এবং আছে। তখনও overthrow-তে পাঁচ রান ব্যাপারটা ঠিক বুঝতাম না!
তো এইরকমই চলছিল। এর মধ্যে খুব সম্ভবত ১৯৬৯ সালের বড়দিনের ছুটিতে এক সন্ধেয় আমারই সমবয়সী (স্কুলের সহপাঠীও বটে) ক্রিকেট-প্রেমী এক জ্যাঠতুতো ভাই, রুন্টু-র বাড়ি গিয়ে আরেক রকম ‘Paper Cricket’ খেলার পদ্ধতি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। সেটার কথাই একটু বলি।
এই পদ্ধতির একটা বড় তফাৎ ছিল ছক-টেস্ট বা Book Cricket-এর সঙ্গে। এতে বোলারদের ওভার ধরে ধরে বোলিং, ব্যাটারদের প্রান্ত-বদল, বিভিন্ন রকমভাবে আউট, অতিরিক্ত রান হওয়া এবং তার সঙ্গে scoresheet লেখা এইসব ব্যবস্থা করা যায় – মোদ্দা কথা, আসল ক্রিকেট-ম্যাচের অনেকটা কাছাকাছি। মনে ধরে গেল ব্যাপারটা। রুন্টুর সঙ্গে খেলতে খেলতে দেখে নিলাম সরঞ্জামের ব্যবস্থাটা, আর বাড়ি ফিরে পরদিন সকালেই বাড়িতে সেটা বানিয়ে ফেললাম। কেমন করে? সেটাই সংক্ষেপে জানাই। চাইলে আপনারাও খেলাচ্ছলে করে দেখতে পারেন – একটু সময় আর ধৈর্য থাকলে!
দু’পিঠই সাদা (রুলটানা বা খোপকাটা নয়) এমন কয়েকটা কাগজের পাতা (ধরুন A4-size) নিন – কাগজটা পাতলা হলে চলবেনা। প্রতিটি পাতা থেকে মোটামুটি ১ ইঞ্চি x ১ ইঞ্চি – বেশি ছোট হ’লে পরে একটু অসুবিধে হ’তে পারে – চার-চৌকো টুকরো কেটে নিন। প্রতিটি টুকরোতে লিখুন – রানের জন্য ‘১’, ‘২’, ‘৩’, ‘৪’, ‘৫’ (overthrow ধরতে চাইলে), ‘৬’ এই সংখ্যাগুলো, পেন্সিল দিয়ে হাল্কা ক’রে, যাতে টুকরোগুলোর উল্টোপিঠ থেকে সেগুলোতে কি লেখা আছে সেটা বোঝা না যায়; dot-ball-এর জন্য টুকরোগুলো ফাঁকা রাখুন।
অবশ্যই সবরকম ধরণের রানের / dot-ball-এর টুকরোর সংখ্যা সমান হবেনা – কারণটা সহজবোধ্য – কী অনুপাতে তারা থাকবে সেটা একটা মোটামুটি আন্দাজ করে নিতে হবে। অবশ্যই এই অনুপাতটা তিন ধরণের ক্রিকেটের জন্য আলাদা করতে হবে – টি২০-তে চার-ছয় বেশি, ওডিআইতে তা একটু কম ও এক-দুই বেশি, টেস্টে চার-ছয় আরেকটু কম ও এক-দুই আরেকটু বেশি। dot-ball-এর জন্য বেশ কিছু ফাঁকা টুকরো বাড়তি বানাবেন, দরকার মতন কমিয়ে-বাড়িয়ে টি-২০ / ওডিআই / টেস্ট চলবে। আমার সময় তো শুধু টেস্টই ছিল।
একইরকমভাবে কিছু আউটের টুকরো লিখুন, সবরকম আউটের – ক্যাচের ক্ষেত্রে চাইলে কট-বিহাইন্ড, কট-অ্যান্ড-বোল্ড, কট-অ্যাট-ক্লোজ-ইন, কট-অ্যাট-আউটফিল্ড এগুলো আলাদা রাখতে পারেন; রান-আউটের ক্ষেত্রে চাইলে বিনা-রানে-আউট, এক-রান-নিয়ে-আউট, দুই-রান-নিয়ে-আউট এগুলোও আলাদা রাখতে পারেন। অবশ্যই সবরকম ধরণের আউটের টুকরোর সংখ্যা সমান হবেনা – কারণটা সহজবোধ্য – কী অনুপাতে তারা থাকবে সেটা একটা মোটামুটি আন্দাজ করে নিতে হবে।
বাকি রইল অতিরিক্ত রানের টুকরো, সবরকমের – বাই / লেগ-বাইয়ের ক্ষেত্রে এক-দুই-চার রান আলাদা রাখতে পারেন। নো / ওয়াইড বলে ব্যাটারের রান ধরলে ব্যাপারটা আরেকটু বিস্তারিত হবে, ধরা বা না-ধরা আপনার ব্যাপার। অবশ্যই সবরকম ধরণের অতিরিক্ত রানের টুকরোর সংখ্যা সমান হবেনা – কারণটা সহজবোধ্য – কী অনুপাতে তারা থাকবে সেটা একটা মোটামুটি আন্দাজ করে নিতে হবে।
এইবার লেখা দিকটা যাতে ভেতরে থাকে এমনভাবে সবরকম টুকরোগুলোর প্রত্যেকটাকে আড়াআড়িভাবে পরপর দু’বার ভাঁজ করে নিন। তারপর সমস্ত ভাঁজ-করা টুকরোগুলোকে একটা বড় চ্যাপ্টা বাটি বা থালা জাতীয় পাত্রে রেখে দিন – চ্যাপ্টা সমান surface-এ, টেবিলের / ডেস্কের ওপরেও রাখতে পারেন। আপনার সরঞ্জাম তৈরি। সঙ্গে scoresheet-টাও তৈরি রাখুন – স্কোর লিখতে না জানলেও মোটামুটি শিখে যাবেন আশা করা যায়, আমিও অনেকটা ঐভাবেই শিখেছিলাম।
এবার একটা একটা ক’রে ভাঁজ-করা টুকরো খুলুন, যেন ম্যাচের এক-একটা ডেলিভারি – যা উঠবে সেইভাবে scoresheet-এ লিখুন, টুকরোটা আবার ভাঁজ করে বাকিগুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দিন, আবার আরেকটা টুকরো তুলুন … আর খেলতে থাকুন। আপনিই অধিনায়ক – দু’পক্ষেরই – অতএব ব্যাটিং-ক্রম ও বোলিং-পরিবর্তন আপনিই ঠিক করবেন। খেলা হয়ে গেলে টুকরোগুলো একটা / একাধিক কৌটোতে রেখে দিন – আবার খেলতে বসার সময় ঢেলে একত্র ক’রে ভালভাবে মিশিয়ে নিন।
১৯৭০, ১৯৭১ ও ১৯৭২ সালে এই পদ্ধতিতে আমি ১৯৭০-৭১ ও ১৯৭১-৭২ দু’মরশুমের পুরো শেফিল্ড শীল্ড প্রতিযোগিতা (পাঁচটা রাজ্যদল প্রত্যেকে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে দুবার করে, অর্থাৎ মরশুমে কুড়িটা করে চারদিনের ম্যাচ) এবং ১৯৭১-৭২ মরশুমে দক্ষিণ আফ্রিকা দলের (আদতে-বাতিল-হওয়া) অস্ট্রেলিয়া সফর (পাঁচ-ম্যাচের টেস্ট-সিরিজ ও ছ’সাতটা প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচ) খেলেছি – সবই আট-বলের ওভার ধরে। তবে দেশের রঞ্জি ট্রফি বা ইংলিশ কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপের অতগুলো ম্যাচ খেলবার ধৈর্যে কুলোবেনা ব’লে এগোইনি। উইজডেন থেকে অস্ট্রেলিয়ার পাঁচটা রাজ্যদলের (New South Wales, Queensland, South Australia, Victoria, Western Australia) খেলোয়াড়দের নামগুলো, এবং খবরের কাগজ থেকে সফরকারী দক্ষিণ আফ্রিকা দলের খেলোয়াড়দের নামগুলো পেয়েছিলাম – ইন্টারনেট তো ছিলনা, তাই!
১৯৭২ সালের থেকে স্কুলে লেখাপড়ার চাপ কিঞ্চিৎ বেশি বাড়তে থাকায় আস্তে আস্তে আমার এককভাবে অবসর-বিনোদনের এই জায়গাটা ছোট হতে থাকে, আর ১৯৭৩ থেকে সেটা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। তবে ঐ সরঞ্জাম এবং scoresheet-গুলো আরো বছর-তিনেক আমার আলমারির একটা তাকের কোণায় সযত্নে রাখা ছিল। তারপর কাগজের টুকরোগুলো নষ্ট হয়ে গেলেও scoresheet-গুলো আমি কলেজ থেকে পাশ করে কর্মক্ষেত্রে ঢোকবার সময় অবধিও ছিল, আমার বালকসুলভ ক্রিকেট-ক্ষ্যাপামোর এক প্রমাণস্বরূপ!