এ যেন শেষ হইয়াও হইল না শেষের গল্প! রাজকোটের বছর চৌত্রিশের ক্রিকেটার বুঝিয়ে দিলেন তাঁকে নিয়ে শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। তাঁর সামনে ভারতীয় দলের দরজা চিরতরে বন্ধ করে দেওয়ার সময় এখনও আসেনি। তিনি চেতেশ্বর অরবিন্দ পূজারা। এ দেশ যখন মারকাটারি টি২০–র আইপিএলে মজে, সুদূর ইংল্যান্ডে তিনি তখন নিজেকে ফিরে পাওয়ার, নিজেকে নতুন করে চেনানোর সাধনায় মগ্ন। সেই কাজে দুশো শতাংশ সফল পূজারা। ইংলিশ কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে গিয়ে রানের সাগরে ভাসছেন তিনি!
কী আশ্চর্য, এই রানই তো তাঁর ব্যাটে ছিল না। প্রায় দু’বছর ছন্দ হাতড়ে বেড়িয়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে রানের খরা (৩ টেস্টে ১২৪ রান, গড় ২০.৬৬) এতটাই ছিল যে, গত ফেব্রুয়ারিতে ঘরের মাটিতে শ্রীলঙ্কা টেস্ট সিরিজে বাদ পড়েছিলেন পূজারা। একই কারণে বাদ পড়েছিলেন অজিঙ্ক্য রাহানেও। প্রাক্তনদের একটা বড় অংশ বলেছিলেন, অনেক সুযোগ পেয়েছে ওরা, এবার নতুনদের দেখে নেওয়া হোক। মনে করা হচ্ছিল পূজারাদের সামনে জাতীয় দলে ফেরার রাস্তা বেশ অন্ধকার। বোর্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তিতে ‘এ’ থেকে ‘বি’ গ্রেডে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল পূজারা, রাহানেকে। পরিস্থিতি মোটেই সুখকর ছিল না ওঁদের কাছে। প্রাক্তনরা বললেন, ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলে ছন্দ পুনরুদ্ধার করুক ওরা। রনজি ট্রফির ম্যাচে নিজ নিজ দলের হয়ে খেললেন পূজারা, রাহানে। সেখানেও তাঁদের পারফরমেন্স নিয়ে বিশেষ চর্চা করার মতো কিছু ছিল না। এবার আইপিএলে নতুন দল পেয়েছেন রাহানে। তিনি ঢুকে পড়লেন টি২০–র আবহে। আর পূজারা? তাঁকে নেয়নি কোনও ফ্র্যাঞ্চাইজি। আর এটাই শাপে বর হল তাঁর।
মন খারাপ করে ঘরে বসে না থেকে চললেন সাসেক্সের হয়ে কাউন্টি খেলতে। সেখানে পূজারার ব্যাট কী বলছে? ডার্বিশায়ারের বিরুদ্ধে ৬ এবং অপরাজিত ২০১, উরস্টারশায়ারের বিরুদ্ধে ১০৯ এবং ১২, ডারহ্যামের বিরুদ্ধে ২০৩, মিডলসেক্সের বিরুদ্ধে ১৬ এবং অপরাজিত ১৭০। সাসেক্স অধিনায়ক টম হেইনস ইনিংস ডিক্লেয়ার না করলে হয়তো তৃতীয় দ্বিশতরান পেয়ে যেতেন পূজারা। সব মিলিয়ে ৭১৭ রান। গড় ১৪৩.৪০। স্ট্রাইক রেট ৬১.২২। এরপরেও পূজারাকে নিয়ে ভাববেন না জাতীয় নির্বাচকরা, এমনটা মনে করার কারণ নেই। ঘুরিয়ে বললে পূজারাই এবার তাঁকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য করাবেন নির্বাচকদের, অধিনায়ক রোহিত শর্মা এবং কোচ রাহুল দ্রাবিড়কে। কাউন্টিতে খেলতে গিয়ে নজিরও তৈরি করেছেন পূজারা। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সবথেকে বেশি (১৫টি) দ্বিশতরান করা ভারতীয় ক্রিকেটার এখন তিনি। শীর্ষে স্যর ডন ব্র্যাডম্যান (৩৭টি)। তালিকায় প্রথম দশে পূজারা ছাড়া একমাত্র ভারতীয় হলেন কিংবদন্তি রনজিৎসিংজি।
ক্রিকেটে ভারত–পাক দ্বৈরথ কবে হবে, তার জন্য হাপিত্যেশ করতে হয়। কিন্তু এক পাক বোলারের বিরুদ্ধে কাউন্টিতে পূজারার দ্বৈরথ দারুণ চর্চিত হয়েছে। মিডলসেক্সের নামী পাক জোরে-বোলার শাহিন শা আফ্রিদিকে যেভাবে আপার-কাটে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টের ওপর দিয়ে ছক্কা হাঁকিয়েছেন পূজারা, তাতে স্পষ্ট, শুধু ছন্দ ফিরে পাওয়াই নয় আত্মবিশ্বাসেরও তুঙ্গে রয়েছেন তিনি। ওই ছয় সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল। আবার এক পাক ক্রিকেটারকে সতীর্থ হিসেবেও পেয়েছেন পূজারা। তিনি আইসিসি–র বিচারে ২০২১–এর বর্ষসেরা ক্রিকেটার মহম্মদ রিজওয়ান। ডারহ্যামের বিরুদ্ধে এই কিপার–ব্যাটারের সঙ্গে পূজারার জুটিতে উঠেছিল ১৫৪ রান। সেই রিজওয়ানও পূজারার খেলা দেখে মুগ্ধ। বলেই ফেলেছেন, ‘কীভাবে ফোকাস ঠিক রাখতে হয়, মনঃসংযোগ বাড়াতে হয়, সুযোগ পেলে আমি পূজারার কাছ থেকে শিখতে চাই।’
মহম্মদ কাইফের ট্যুইটটা উল্লেখ করার মতো। লিখেছেন, “ইন্ডিয়া টিমের বাইরে থাকলে গ্রেট প্লেয়ারদের কী করা উচিত? ১০০ এবং ২০০ করে নির্বাচকদের দরজায় টোকা মারা, ঠিক পূজারার মতো। আইপিএলের গ্ল্যামার থেকে দূরে সরে গিয়ে পূজারার পরিষ্কার বার্তা, ‘আমাকে ভুলে যাওয়া যাবে না’’’। ইদানীং ইংল্যান্ডে কেউ কেউ মজা করে বলছেন, ভারতে সুযোগ না পেলে পূজারাকে অনায়াসে বেন স্টোকসের দলে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু জুলাইয়ে স্টোকসের দলের বিরুদ্ধে এজবাস্টন টেস্টে পূজারাকে বাদ দেওয়া সহজ হবে না দ্রাবিড়, রোহিতদের।