“জার্সি” – রিভিউ

প্রথমত থেকে দ্বিতীয়ত হয়ে শেষ পর্যন্ত এই পোস্টটা তথাকথিত ফিল্ম-সুশীলদের জন্য নয়। কারণ, “৮৩” নিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া আমার চোখে দেখা। “৮৩”-র মত এটিও একটি মেনস্ট্রিম ক্রিকেট নিয়ে ফিল্মের “কথা ও কাহিনী”, যা দেখতে গেলে অধিকাংশ ফিল্ম-সুশীলদের ভ্রূ একটু বেশিই কুঞ্চিত হয়ে ওঠে। তফাতের মধ্যে, “৮৩” ছিল সত্যি ঘটনা অবলম্বনে, “জার্সি” তা নয়।

কাউকে, এমনকি কোচ মাধব শর্মাকেও (পঙ্কজ কাপুর) কিছু না বলে, ১৯৮৬তে ভরা ৩০ বছরে ক্রিকেট ছেড়ে দেন এক রণজি ট্রফি সফল (কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন হওয়াসহ) কিন্তু ভারতীয় দলের দরজা খুলতে অপারগ  পাঞ্জাবি ক্রিকেটার অর্জুন তলওয়ার (শাহিদ কাপুর) এবং তাঁর মাঠে প্রবেশই একরকম বন্ধ হয়ে যায়। তারপরে যা হবার, তাই হয় পরপর, খেলার সময়ের প্রেমিকা বিদ্যা তলওয়ারকে (ম্রুণাল ঠাকুর) ইলোপ করে চাকরিজীবী অর্জুনের বিয়ে করা, তুমুল ভালবাসাময় অনটনের গৃহস্থ জীবনযাপন, ছেলে কেতন তলওয়ার ওরফে কিট্টুর (শিশুশিল্পী রণিত কামরা) জন্ম। হঠাৎই ছন্দপতন, চাকরি থেকে সাসপেন্ড হন অর্জুন, চলতে থাকে এ নিয়ে মামলা। একটি হোটেলের মোটামুটি পদে কর্মরতা বিদ্যা টানতে থাকেন সংসার। ঘরে বসে জং ধরতে থাকে অর্জুনের মনে এবং অর্জুন-বিদ্যার সম্পর্কেও।এভাবেই একদিন অর্জুনের ক্রিকেট অবসরের বয়েস হয় ১০, আর অর্জুন প্রায় ৪০। কিট্টুও ততদিনে ক্রিকেটে উৎসাহ পেয়ে গেছে।

এমনই সময় কিট্টুর জন্মদিনে তার চাওয়া একটি ক্রিকেট জার্সি দেবার ক্ষমতা না হওয়ার বিদ্যার পার্স থেকে টাকা নিতে গিয়ে ধরা পড়ে বিদ্যার কাছে চরম গঞ্জনার শিকার অর্জুন আচমকা একটি সিদ্ধান্ত নেন, ক্রিকেটে ফিরে আসার। সালটা ১৯৯৬, জন্মদিনে জার্সি পাওয়া হয়না কিট্টুর। অর্জুনের ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তনে বিদ্যার প্রবল আপত্তি উড়িয়ে দিয়ে নিরলস পরিশ্রম ও স্বভাবজাত প্রতিভার যোগফলে কয়েকটি স্থানীয় ম্যাচে তাঁর খেলার দৌলতে অর্জুন রণজি ট্রফির পাঞ্জাব দলের প্রাথমিক ট্রায়ালে ডাক পান, সেখান থেকে স্থান পান চূড়ান্ত পাঞ্জাব দলে। এ ব্যাপারে তাকে প্রচুর সাহায্য করেছিলেন ২ জন। ১০ বছর আগের কোচ ও এখনকার সহকারী কোচ মাধব শর্মা এবং সাংবাদিক জসলিন শেরগিল (গীতিকা মেহান্দ্রু)।

মূলত তাঁরই পারফর্মেন্সের জোরে গ্রুপ লীগ ও কোয়ার্টার-ফাইনালের বাধা কাটিয়ে সেমি-ফাইনালে ওঠে পাঞ্জাব। সেমি-ফাইনাল চলাকালীন মাঠেই নিঃশ্বাসের কষ্টে অসুস্থ হয়ে পড়ে অর্জুন, কিন্তু মাঠ ছেড়ে হাসপাতালে যাবার আগে টিমকে জিতিয়ে দেয়। সুস্থ হলেও আর খেলতে বারণ করেন চিকিৎসকরা। ফাইনালে ভিনরাজ্যে খেলতে যেতে আপত্তি জানায় বিদ্যা, কিন্তু কিট্টু বলে “তুম খেলো পাপা, দিল সে খেলো। তুম যব খেলতে হো, একদম হীরো লাগতে হো”। শেষ অবধি রাজি হয়ে যান বিদ্যাও। টিমের সঙ্গে ট্রেনে না, আলাদাভাবে বিমানে চেপে খেলতে যান অর্জুন। ফাইনালেও কর্ণাটকের বিরুদ্ধে অসাধারণ খেলে টিমকে জেতান অর্জুন, কিন্তু ম্যাচের শেষদিকে দৃশ্যতই চরম অসুস্থও হয়ে পড়েন। সেদিনই রাতে বিসিসিআই-র উদ্যোগে ভারতীয় দল নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল।

এরপরে ২০১৮-তে চলে যায় ঘটনাক্রম, উপলক্ষ অর্জুন তলওয়ারকে বিসিসিআই-র মরণোত্তর সম্মান প্রদর্শন। ক্রীড়াসাংবাদিক জসলিন শেরগিলের লেখা অর্জুন তলওয়ারের জীবনীভিত্তিক একটি বই “জার্সি”-র উদ্বোধন হয় সেদিন। ততদিনে কেতন ওরফে কিট্টু (প্রীত কামানি) ২৮ হয়ে গেছেন। মা বিদ্যাকে নিয়ে তিনি সেই অনুষ্ঠানে যান। সেখানে কেতনের জন্য একটি বিশেষ উপহার রেখেছিলেন উদ্যোক্তারা – একটি ভারতীয় দলের জার্সি, পিছনে অর্জুনের নাম লেখা। সেদিন জানা যায়, ১৯৯৬-৯৭-এর ফাইনালের রাতে ভারতের যে দল নির্বাচন হয়েছিল, তাতে অর্জুন তলওয়ার নামে একজন ছিলেন।এবং তার দিনদুয়েকের মধ্যেই হাসপাতালে মারা যান অর্জুন। নইলে তিনিই হতেন ভারতের হয়ে ডেবিউ করা বয়োজ্যেষ্ঠ ক্রিকেটার। ২২ বছর আগের জন্মদিনের বকেয়া জার্সি এভাবেই অর্জুন শেষ পর্যন্ত তুলে দিতে পেরেছিলেন তার কিট্টুর হাতে।

ইচ্ছেপূরণের এই গল্প নিয়েই বালাজি টেলিফিল্মসের ডিস্ট্রিবিউশনে ঠাসবুনোট একটি দৃশ্যশ্রাব্য চিত্রকল্প দেখা যাচ্ছে গৌতম তিন্নানুরি-র পরিচালনায়। শ্রুতিমধুর কয়েকটি গান আছে এই ফিল্মে, যার সুরকার সাচেত ট্যান্ডন-পরম্পরা।আর এই ছায়াছবির আসল সম্পদ হলো অভিনয়। শাহিদ কাপুর, ম্রুণাল ঠাকুর, রণিত কামরা. প্রীত কামানি, গীতিকা মেহান্দ্রু এঁরা প্রত্যেকেই যথাযথ এবং দুরন্ত অভিনয় করেছেন, তবে সবাইকে ছাপিয়ে চোখে পড়ে যান সেই বহু যুদ্ধের “বুড়ো ঘোড়া” পঙ্কজ কাপুর। একজন কোচের এরকম ডিটেলসে চরিত্রায়ণ তিনি ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব ছিলনা। ভারতীয় চলচ্চিত্র ভাগ্যবান যে তাদের ঝুলিতে পঙ্কজ কাপুরের মত অভিনেতা আছেন।

এক সৎ ক্রিকেটারের তার পরিবারের কাছে হীরো হয়ে থাকার জন্য আক্ষরিক অর্থে আপ্রাণ চেষ্টা করার গল্প সেলুলয়েডে বলে যায় “জার্সি”। অনেকটাই বলে দেওয়া এই গল্পে এর চেয়েও অনেক বড় একটি চমক (অর্জুন তলওয়ারের অকাল অবসর সংক্রান্ত একটি বেদনাবিধুর ঘটনা) অনুক্ত রেখে দিলাম, যেটা সিনেমাহলে গিয়ে দেখার জন্য অনুরোধ রইল পাঠক-পাঠিকাদের কাছে।