মে মাস পড়ে গেছে, দিনে আট ঘন্টা কাজের দাবি জানিয়ে!
একদিকে মুম্বাইতে রোজ সন্ধ্যায় সাড়ে তিন ঘন্টায় বাজিমাত করবার আইপিএল চলছে দাপিয়ে এবং কোভিড ছাপিয়ে। অন্যদিকে ইংল্যান্ডে চেতেশ্বর পূজারা ইংলিশ কাউন্টিতে শতরানের ঝাঁপি খলে বসেছেন।
এদিকে কলকাতায় (নববর্ষ উৎসবের হর্ষ সামলে) বাঙালিরা অনেকেই এখন হয়ত ‘মে’-গৌরবের পুরনো ঘিয়ের গন্ধ ‘সৃষ্টিসুখের উল্লাসে’ শুঁকতে শুরু করেছেন – মান্না, সত্যজিৎ, রবীন্দ্রনাথ, উপেন্দ্রকিশোর, দেবেন্দ্রনাথ, রামমোহন, নজরুল, রাসবিহারী [আইনজ্ঞ-সমাজসেবী ঘোষ নন], রামকিঙ্কর, পঙ্কজ [গায়ক-সুরকার মল্লিক নন] – আর আমার মনে পড়ছে সুকুমার রায়ের “অবাক জলপান” নাটকের সেই “… ক’টা হ’ল? গোনোনি বুঝি?” সংলাপটা। গুণতে তো হবেই, রান-উইকেট-ক্যাচ (অবশ্যই চার-ছয়ও) না গুণলে ক্রিকেটের মজা কই!
তাহলে আসুন, আসন্ন কবিপক্ষের প্রাক্কালে রবিঠাকুরের সচিবসম অমিয় চক্রবর্তীর “মেলাবেন তিনি মেলাবেন” স্মরণ করে – মে মাস, কাউন্টি ক্রিকেট আর ব্যাটিংয়ের দাপট – এই তিনটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে-থাকা বিন্দুকে মেলাবার একটা চেষ্টা করি।
ইংলিশ কাউন্টি দলগুলোর হয়ে কাউন্টি ক্রিকেট (ল্যাঙ্কাশায়ারের বিভিন্ন লিগের কথা বলছিনা) খেলেছেন বহু বিখ্যাত ও অল্পখ্যাত ভিনদেশি ক্রিকেটার, আর এই ব্যাপারে আমার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মনে হয় ষাট-সত্তর-আশির দশকের দুনিয়া-কাঁপানো ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটারদের কথা, বিশেষত সত্তরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে নব্বইয়ের প্রথমার্ধ এই সময়টা। জেফ দুজোঁ-র মত মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে বাদ দিলে তৎকালীন ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটাররা প্রায় সবাই ইংলিশ কাউন্টিতে খেলেছেন। শুধু তাই নয়, গ্যারি সোবার্স [প্রথমবার প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে ছ’বলে ছ’টা ছক্কা] ও ব্রায়ান লারা [প্রথমবার প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে ব্যক্তিগত পাঁচশো রানের ইনিংস] বিশ্বরেকর্ডও করেছেন এই কাউন্টি ম্যাচেই।
এই প্রসঙ্গে একটা খানদানি ব্যাটিং রেকর্ডের কথা বলি যেটা আজ পর্যন্ত মাত্র আটজন ক্রিকেটার অর্জন করতে পেরেছেন – রেকর্ডটা হয়েছে মাত্র ন’বার – ডব্ল্যু জি গ্রেস (১৮৯৫ সালে ১০ ইনিংসে), টম হেওয়ার্ড (১৯০০ সালে ১৩ ইনিংসে), ওয়ালি হ্যামন্ড (১৯২৭ সালে ১৩ ইনিংসে), চার্লি হ্যালোজ (১৯২৮ সালে ১১ ইনিংসে ), ডন ব্র্যাডম্যান (১৯৩০ সালে ১১ ইনিংসে ও ১৯৩৮ সালে ৭ ইনিংসে), বিল এডরিচ (১৯৩৮ সালে ১৫ ইনিংসে) – এই হচ্ছে প্রথম ছ’জনের নাম যাঁদের মিলিয়ে প্রথম সাতবারের হিসেব, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে পর্যন্ত, এঁদের মধ্যে একমাত্র ভিনদেশি সেই ‘ডন’ যাঁকে “পকড়না সির্ফ মুশকিলহি নহী, নামুমকিন হ্যায়”। হ্যাঁ, আমি বলছি ইংলিশ ক্রিকেটে এক মরশুমে “মে মাসের মধ্যে হাজার রান” করবার কৃতিত্বের কথা। মনে পড়ছে এঁদের কথা?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সাড়ে-সাত দশকেরও বেশি সময়কালে এ যাবৎ এই রেকর্ড হয়েছে আরো মাত্র দু’বার। করেছেন, গ্লেন টার্নার (১৯৭৩ সালে ১৮ ইনিংসে), এবং গ্রেম হিক (১৯৮৮ সালে ১১ ইনিংসে)। এই দু’জনের ম্ধ্যে অন্তত আরো তিনটে মিল আছে: (১) এঁদের দু’জনেরই জন্ম ইংল্যান্ডের বাইরে, অর্থাৎ ‘বিদেশে’ – টার্নার-এর নিউজিল্যান্ডের ড্যুনেডিন শহরে, আর হিক-এর রোডেশিয়ার স্যালিসবেরি (বর্তমানে জিম্বাবোয়ের হারারে) শহরে; (২) দু’জনেরই জন্ম মে মাসে – টার্নার-এর ১৯৪৭ সালের ২৬শে মে, আর হিক-এর ১৯৬৬ সালের ২৩শে মে; এবং (৩) দুজনেই এঁরা কাউন্টি ক্রিকেট খেলতেন উরস্টারশায়ার দলের হয়ে। এঁদের নিয়ে কিছু কথা বলি।
গ্লেন টার্নার ছিলেন প্রকৃত অর্থেই নিউজিল্যান্ডের প্রথম পেশাদার ক্রিকেটার। ১৯৬৯ সালে অকল্যান্ডে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে শূন্য রানের ইনিংস দিয়ে টেস্ট-অভিষেক হওয়া এই ওপেনার তাঁর টেস্ট-জীবন শেষ করেন ১৯৮৩ সালে ওয়েলিংটনে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে – ৪১ ম্যাচে ২,৯৯১ রান (সর্বোচ্চ ২৫৯) গড় ৪৪.৬৪, ৭টা শতরান ১৪টা অর্ধশতরান ও ৪২টা ক্যাচ। এত কম ম্যাচ কেন খেলেছেন ১৪ বছরে? কারণ, ১৯৭৭-এর মার্চ থেকে ১৯৮৩-এর ফেব্রুয়ারি, এই ছ’বছর নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের (তৎকালীন) কর্মকর্তাদের সঙ্গে ওঁর নিয়মিত বড়সড় মতভেদ। উনি দল থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন।
খাঁটি টেস্ট-ওপেনারের মতই প্রধানত সোজা-ব্যাটেই উনি খেলতেন। [আপনারা হয়ত হাসছেন, কিন্তু আমি যে অর্ধশতাব্দী আগেকার টেস্ট-ক্রিকেটের কথা বলছি!] তবে অফ-ড্রাইভ এবং মিড-উইকেট বা মিড-অন দিয়ে নিখুঁত টাইমিংয়ের ড্রাইভ ছিল ওঁর ব্যাটিংয়ের বিশেষত্ব।
ওঁর কয়েকটা টেস্ট-কৃতিত্ব উল্লেখ করি: (১) ৭৩টা টেস্ট-ইনিংসে মাত্র একটা শূন্য ক’রে উনি এই বাবদে ক্রিকেট-বিশ্বে তৃতীয় [ওঁর আগে আছেন অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজ ১৬৯ ইনিংসে দু’টো ও ক্লাইড ওয়ালকট ৭৪ ইনিংসে একটা]; (২) একই টেস্ট-সিরিজে দু’টো দ্বিশতরান – ১৯৭২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে কিংস্টনে (২২৩*) ও জর্জটাউনে (২৫৯) – ঐ সফরে উনি চারটে দ্বিশতরানের ইনিংস খেলেন, বাকি দু’টো দ্বিশতরান ছিল প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচে; (৩) টেরি জার্ভিস (১৮২)-এর সঙ্গে ১৯৭২ সালের জর্জটাউন টেস্টে ৩৮৭ রানের ওপেনিং জুটি; (৪) ১৯৭৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ক্রাইস্টচার্চে দু’ইনিংসে শতরান (১০১ ও ১১০*) – ঐ ম্যাচে টাসমান সাগরপারের প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে কিউয়িদের প্রথম টেস্ট-জয় এসেছিল ওঁরই অধিনায়কত্বে।
আপনাদের কারো কারো হয়ত মনে হচ্ছে যে টার্নারের মত ‘রক্ষণশীল’ ব্যাটার ওডিআই-তে নিশ্চয়ই দলের বোঝা হয়ে দাঁড়াতেন! আসুন, দেখা যাক একঝলক। বিশ্বকাপে ১৯৮৩ সালের ১৮ই জুন কপিল দেব ১৭৫* ক’রে গড়েছিলেন ওডিআইতে (বিশ্বকাপে তো বটেই) ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ড – সেটা ১৯৭৫ সালের ৭ই জুন থেকে ছিল টার্নারের দখলে (১৭১* রান, ২০১ বল, ৪x১৬, ৬x২), এজবাস্টনে পূর্ব আফ্রিকার বিরুদ্ধে এই ইনিংসটা আজও ওডিআইতে খেলা ২০০-বা-তার-বেশি বলের একমাত্র ব্যক্তিগত ইনিংস। সেই ১৯৭৫ বিশ্বকাপে তিনি আরেকটা ম্যাচ-জেতানো শতরান করেন, ১৯৭৫ সালের ১৪ই জুন ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ভারতের বিরুদ্ধে ১১৪* (১৭৭ বল, ৪x১৩) – সেই বিশ্বকাপে চার ইনিংসে তিনি করেন – ১৭১*, ১২, ১১৪*, ৩৬ – মোট ৩৩৩ রান, গড় ১৬৬.৫০ ও স্ট্রাইক-রেট ৬৮.৫১; পরের ১৯৭৯ বিশ্বকাপেও বেশ ধারাবাহিক – ৮৩*, ৪৩*, ২০, ৩০ – মোট ১৭৬ রান, গড় ৮৮.০০ ও স্ট্রাইক-রেট ৫৬.০৫; তার পরের ১৯৮৩ বিশ্বকাপেও খেলেছিলেন কিন্তু সুবিধে করতে পারেননি। সেটাই ওঁর শেষ আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা।
টার্নার-কথা শেষ করি ওঁর আরেকটা বিশ্ব-রেকর্ডের কথা জানিয়ে: লাল-বলের ক্রিকেটে, টেস্ট ও প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচ মিলিয়ে, একশো-বা-তার-বেশিসংখ্যক শতরান করেছেন মাত্র চারজন অ-ইংরেজ ক্রিকেটার – ডন ব্র্যাডম্যান (১১৭), ভিভ রিচার্ডস (১১৪), জাহির আব্বাস (১০৮) এবং গ্লেন টার্নার (১০৩) – ১৯৮২ সালের ২৯শে মে (আবার সেই মে মাসে!) টার্নার এই ‘শততম শতক’-এর কৃতিত্বটা অর্জন করেন, ব্র্যাডম্যানের (১৯৪৭ সালের ১৫ই নভেম্বর) পরে প্রথম অ-ইংরেজ ক্রিকেটার হিসেবে।
১৯৭৩ সালের ইংল্যান্ডের মরশুমে সর্বাধিক (২,৪১৬) রান সংগ্রহকারী এই ব্যাটারকে বিখ্যাত ইংরেজ ক্রিকেট ভাষ্যকার-সাংবাদিক-লেখক Christopher Martin-Jenkins (ওরফে CMJ) বর্ণনা করেছিলেন “’unswervingly single-minded in his pursuit of runs’ and ‘unashamedly ambitious’” এই ব’লে – একদম যথাযথ বর্ণনা।