হিসাবি দুনিয়ায় ম্যাড়মেড়ে সাদা-কালোর ভিড়ে বিদ্যুৎচমকের সোনালি রেখা

ছাপোষা, প্রভিডেন্ট ফান্ড-গ্র্যাচুইটি-পেনশনের আবর্তে তিনি মূর্তিমান বেমানান!
সাধারণ্যে কামিনী রায় আছেন। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’। চেপেচুপে-ঢেকেঢুকে চলা, অন্যের চোখে নিজেকে ভাল দেখতে চেয়ে, ভাল সাজতে চেয়ে। ছ’টা সতেরোর শান্তিপুর লোকাল ধরে আটটা ছাব্বিশে বাড়ি-ফেরার নিয়মানুবর্তিতা। ফেরার পথে বৈঠকখানা বাজার থেকে সস্তায় চারটে পাতিলেবু, পাঁচশো কাটাপোনা আর আড়াইশো মুসুরির ডাল নিয়ম করে কেনার আটপৌরে দিনলিপি। সমাজ-শিক্ষক নিদান হাঁকছেন প্রতি দিন। নিজেকে সামলে চলাই সভ্যতা। আমি কী চাই, স্বার্থপরের ভাবনা। জীবন আমার হতেই পারে। কী করে বাঁচবেন ঠিক করে দেবে অন্যে। তাই-ই সভ্যতা। লোকের চোখে দেখতে শিখুন নিজেকে। না হলেই সমাজের ভুরু কুঁচকে, চোখ কপালে!


ব্রায়ান চার্লস লারা নামের যে ক্রিকেটার খেলতেন, কাঁধের ওপরে তোলা ফলোথ্রু-র ব্যাটে চাবকে সিধে করতেন এই সমাজবদ্ধ সভ্য নিয়মগুচ্ছকে। বাল্যবন্ধু ডোয়াইট ইয়র্ক খেলবেন চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনাল। নিজের বিশ্বকাপ চলছে তো কী? ম্যানেজার ক্লাইভ লয়েডকে গিয়ে জানিয়ে এলেন। স্যর, ভুলভাল কিছু দলের বিরুদ্ধে খেলার কোনও প্রয়োজন নেই আমার। আমি চললাম ইয়র্কের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের খেলা দেখতে। বাকিটা সামলে নিন আপনি! এ-ঘটনা ১৯৯৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলাকালীন। ইংরেজ কাগজ — যেখানে ১৮ পাতা ফুটবল নামক এক অর্বাচীন খেলার রিপোর্ট ভরে থাকে আর ১৯৯৯ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিয়ে সিঙ্গল কলাম, দুশো শব্দ, যা নিয়ে হর্ষ ভোগলেদের চিরকালীন অসূয়া প্রকাশিত হয় পৃষ্ঠপোষিত কলামে — শব্দভেদী বাণ ছোঁড়ে তখন লারা-উদ্দেশে। শর্ট আর্ম পুল ফেরত পায়, সপাট!
তাঁর সময়ের সেরা দল অস্ট্রেলিয়া। টেস্টে ২৮৫৬ রান করেছিলেন, ৯ শতরান। প্রথম শতরান ২৭৭, সিডনিতে। আদুরে কন্যার নামও তাই সিডনি। ম্যাকগ্রা-ওয়ার্নদের বিরুদ্ধে টেস্ট-গড় ৫১.০০ যা টেস্টে তাঁর ব্যাটিং-গড়ের (৫২.৮৮) প্রায়-সমান। তিনি খুশি, সন্তুষ্ট। বাকিরা মাথা ঘামাবেন বাকিগুলো নিয়ে।
বিশ্বসেরা স্পিনার মুথাইয়া মুরলিথরনের বাড়িতে গিয়ে তিন টেস্টের সিরিজে ৬৮৮ রান! দেশ হারে ০-৩, তিনি একবারও প্রশ্ন তোলেন না, ‘বাকিরা কে কী করল?’ শতরান করে আউট হয়ে গিয়ে দেশ হারার পর এমন প্রশ্ন তোলার লোক অনেক যখন, তিনি আবারও ব্যতিক্রম। হ্যাঁ, মুরলির উঠোনে গিয়ে তাঁর টেস্ট-প্রতি প্রায় ২৩০ রান করে আসার পরও, আলোকপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞদের দলের বাকি দশজনের অযোগ্যতা নিয়ে হিরণ্ময় নীরবতা! ১৫৩-র অপরাজিত আনন্দ মনে আছে তো? কিছু কিছু ইনিংসের দিনক্ষণ বিপক্ষ লাগে না, স্রেফ সংখ্যাই বলে দেয় সব। যেমন ৪০০, ৫০১-ও।
ধারাবাহিকতার ধ্বজাধারীরা আছেন। দিন-আনি দিন-খাই দলে। রোজ খেটেখুটে, খুঁটে, ৩৮ করতেই হবে। ধারাবাহিকতার অর্থই যে তাই। জিম কুরিয়ার। ক্লে কোর্টে ঘ্যানঘ্যানে নির্ভুল। কোনও পড়া নেই, ওঠাও নেই। জিতলেও যা, হারলেও তাই। সমতল জীবন, আলুনি। রোজ আট ঘণ্টা জিমে কাটাতেই হবে, টেনিস কোর্টে চার ঘণ্টা। শুনে, ঠিক বলেছিলেন জন ম্যাকেনরো। ‘আট ঘণ্টা জিমে থাকলে টেনিস খেলতাম কখন আর টাটুমের (ও’নীল) সঙ্গে উদ্দাম প্রেমে ভেসে যেতামই বা কখন? আর, আমার গিটারটার যে কী হত!’
ক্যারিবিয়ান সাগরের উদ্দামতা গায়ে-মেখে জন্ম লারার। ঢেউ সেখানে উচ্ছ্বল। ওঠে-নামে, দুরন্ত হয়ে বেলাভূমিতে আছড়ে পড়ে। কবির কল্পনায় অশান্ত পুরুষ-ঢেউ শান্তির খোঁজে আশ্রয় নেয় নারী-তটভূমিতে। লারাও তাই বারবার খোঁজেন নতুন আশ্রয়। লারারা এমনই। তাঁকে ‘কুলুঙ্গিস্থিত’ হতে হবে, কেউ বলেনি। বললেই বা শুনছে কে! বয়ে গিয়েছে তাঁর। তাই তো, ৪৭ রান বাকি টেস্টে প্রথম বারোহাজারি হতে, আর একটি ম্যাচ খেললেই একদিনে ৩০০-ক্লাবে, এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ব্যাট তুলে রাখার মতো চূড়ান্ত বেহিসেবি, বেনিয়ম!


খেলতেন যখন, তাঁর প্রিয় বন্ধুর নাম ছিল গ্যারি সোবার্স। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার, অবিতর্কিত। তাঁর রেকর্ড ভেঙে লারা যখন টেস্টে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের নতুন রেকর্ড লিখছেন, মাঠে নেমে এসেছিলেন অভিনন্দন জানাতে। আর, দুই অসমবয়সি কিন্তু একই মানসিকতার মানুষের গভীর রাতের আড্ডায় পানপাত্রে চলকে যেত সময়। দুজনেরই বিশ্বাস ছিল গভীর। জীবন উপভোগের জন্য, গুমরে গুমরে কেঁদে বাঁচায় নয়। বুড়ো যেন বলতেন, ‘তোর ব্যাটে ব্রায়ান রে, সব ভুলে গেছি রে’!
ভিভ রিচার্ডসের দেওয়া টিমলিস্ট থেকে ভিভের পছন্দের ক্রিকেটারের নাম কেটে নিজের পছন্দের ক্রিকেটারকে প্রথম এগারয় রাখলেও ভিভের সঙ্গে সম্পর্কে অবনতি হয়নি যা হয়েছিল মাইকেল হোল্ডিং-এর সঙ্গে। লারাকে দেখতে পারেন না বললেও কম বলা হবে হোল্ডিং সম্পর্কে। তো, সেই হোল্ডিং-এর কাছে শচীন-লারার পার্থক্য জানতে চেয়েছিলেন গোপাল বসু, এক সান্ধ্য-আড্ডায়, আজকাল-এর ক্রিকেট-লিখিয়ে দেবাশিস দত্ত-র টালিগঞ্জের বাড়িতে। যা বলেছিলেন হোল্ডিং — ফাস্ট ও বাউন্সি পিচে এবং সত্যিকারের ফাস্ট বোলারদের বিরুদ্ধে ‘সারভাইভ’ করবেন শচীন আর ‘ডমিনেট’ করবেন লারা। এমন বিশ্লেষণই বা আর শুনলাম কই!
বড় বেরঙিন হিসাবি দুনিয়ায় ম্যাড়মেড়ে সাদা-কালোর ভিড়ে বিদ্যুৎচমকের সোনালি রেখা ছিলেন ব্রায়ান লারা, মেঘ যাঁর উপস্থিতির প্রথম ও প্রধান শর্ত। ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা মনে করিয়ে অবিকল, ‘মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে’!