মোহালিতে সিরিজের প্রথম টেস্টে শ্রীলঙ্কাকে ফলো-অন করিয়ে এক ইনিংস এবং ২২২ রানে জিতল ভারত। তিন দিনেই খেলাশেষ। শ্রীলঙ্কার বর্তমান অবস্থার নিরিখে খুব আনন্দের কোনও ‘অ্যাচিভমেন্ট’ হয়ত নয়। তথাপি জয় সর্বদাই একটি স্বস্তিদায়ক সংবাদ। কিন্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় মাংসাশী সমর্থকরা এর মধ্যেই তোলপাড় শুরু করেছেন। লক্ষ্য ভারতীয় দলের হেড কোচ রাহুল শরদ দ্রাবিড় এবং অধিনায়ক রোহিত শর্মা।
‘সামাজিক মাধ্যম’ নামক চণ্ডীমন্ডপে কলহপ্রিয় জনগণের রাগের কারণ র-র (রাহুল-রোহিত) জুটির দুটি সিদ্ধান্ত। প্রথমটি, রবীন্দ্র জাদেজার ব্যক্তিগত ১৭৫ রানের মাথায় প্রথম ইনিংসে ডিক্লেয়ার করে দেওয়া এবং দ্বিতীয়ত, শ্রীলঙ্কাকে ফলো-অন করানো। যার ফলে না কি বিরাট কোহলীর শততম টেস্টে শতরান করার সুযোগ ফস্কে গেলো।
এই উপমহাদেশ ব্যক্তিপুজার ক্ষেত্র। সর্বদাই দলগতর বাইরে জনৈক/জনৈকার উপর দেবত্ব আরোপ করে আরাধনাই এ’দেশের রীতি। রাজনৈতিক দলগুলিতেও এই মানসিকতার প্রতিফলন। এই ‘হিরো ওয়রশিপ’ ক্রিকেট খেলাতেও ছিল এবং আছে। এমনকি খেলা বা দেশের স্বার্থের থেকেও ব্যক্তিস্বার্থ ভয়ঙ্কর প্রকট। সেই ব্যক্তিস্বার্থে সামান্য একটি আঁচড়ও ফেসবুককে রাতারাতি হরিয়ানার খাপ পঞ্চায়েতে পরিণত করতে পারে। প্রাণদণ্ড না হলেও বস্ত্রহরণে উদগ্র হয়ে পড়েন জনতা।
দল ৫৭৪ রান করে ফেলেছে। এই শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে যথেষ্ট রান। এমতাবস্থায় ডিক্লেয়ার করাই যায়। রবীন্দ্র জাদেজা ১৭৫ রান করে আছেন। অন্যদিকে মহম্মদ শামি ২০। জাদেজাকে যদি দ্বিশতরানের সুযোগ দেওয়া হত, তবে প্রোবাবিলিটি থিওরিতে শামিও হয়ত ততক্ষণে ৪০ রান করে ফেলতেন। টেল এন্ডারের হাফ সেঞ্চুরীর সুযোগ আসেনা। অতএব তাঁরও অর্ধশতক করতে যেতেন, তবে আবারও যদি-কিন্তুর কল্পনায় জাদেজা সওয়া দু’শো করে ফেলতে পারতেন। সামনে আড়াইশোর হাতছানি। অতএব সমস্ত ব্যক্তিস্বার্থকে সন্তুষ্ট করে দান ছাড়তে আরও একটি সেশান পেরিয়ে যেত।
রবীন্দ্র জাদেজা একজন স্ট্রাইক বোলার। মহম্মদ শামি বোলিং ওপেন করেন। তাঁদের ব্যাটিং এবং বোলিংয়ের মাঝে কিছু সময় বিশ্রাম দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও অস্বীকার করা যায়না। খেলোয়াড়রা মানুষ। রোবট নন। ক্রমাগত প্যাড পরে লম্বা সময় দৌড়ের পর বল হাতে দৌড় শুরু করলে যে কোনও মুহূর্তে পায়ের পেশীতে টান ধরতে পারে। এই বিষয়টি কোচ-অধিনায়ককেই তো মাথায় রাখতে হবে। অতএব ডিক্লেয়ার করাটা সঠিক সিদ্ধান্তই ছিল।
এবার আসি দ্বিতীয় প্রসঙ্গে। প্রাক্তন অধিনায়ক বিরাট কোহলীর সেঞ্চুরী খরা এমন কি বড় রান না আসা বিগত দুই বছরেরও বেশী সময় ধরে চলছে। মাঝের লকডাউনের সময়টি বাদ দিলেও যত দিন যাচ্ছে, বিরাট ও সেঞ্চুরীর বিরহকাল দীর্ঘতর হচ্ছে। তাঁর শততম টেস্টে শতরান আসার আশা অনেকেই করেছিলেন। প্রথম ইনিংসে ৪৫ রানের মাথায় এম্বুলদেনিয়ার বল অফ-স্টাম্প ছিটকে দেওয়ায় সেই আশা কেওড়াতলার পথে যায়।
প্রথম ইনিংসে জাদেজার পাঁচ উইকেটের সুবাদে ভারত ৪০০ রানের লিড পায়। ২০০১ সালে ইডেনে লক্ষ্মণ-রাহুল শোয়ের পর থেকেই ফলো-অন করানোয় অনীহা দেখা যাচ্ছে। চতুর্থ ইনিংস খেলার ঝুঁকি অনেক দলই নিতে চাইছেন না। কিন্তু ভারতের হাতে ৪০০ রানের লিড। এই শ্রীলঙ্কাকে আরও একবার অল আউট করার জন্য যথেষ্ট। অতএব টিম ম্যানেজমেন্ট চাইবেন, যত দ্রুতসম্ভব খেলা শেষ করতে। যদি তিন দিনে খেলা শেষ করা যায়, তবে খেলোয়াড়রা দু’দিন বিশ্রাম পাবেন। ঠাসা শিডিউলে যা আশীর্বাদ। বিশাল মরসুম শেষ হতে যাচ্ছে এবং কয়েক দিনের ব্যবধানে আবার ক্রিকেটারদের গিলে খাওয়ার জন্য নতুন একটি মরসুম হাঁ করে আছে। বিশ্রাম এক্ষেত্রে আবশ্যক। আর দ্বিতীয় ইনিংসে বিরাটের শতরান করার সম্ভাবনা যত, না করার সম্ভাবনাতার থেকে নিরানব্বই গুণ বেশী। তাই, সুযোগ পেলেই সেঞ্চুরী হত এমনটা ভাবার কারণ নেই।
অতএব, রাহুল-রোহিত জুটি যে দুটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, প্রতিটি খেলোয়াড়ের কথা ভেবেই নিয়েছেন। ফেসবুকের কলতলায় জবাবদিহির দায় তাঁদের নেই। সমর্থক, আপনি কনজিউমার হতেই পারেন, কিন্তু ম্যানেজমেন্ট নন। ভাগ্যিস নন।