মাঠ ভর্তি দর্শকের বুকের মধ্যে ধুকপুকুনির ড্রাম বাজিয়ে, চুইংগাম চিবোতে চিবোতে তাঁর সেই উদ্ধত রাজার ভঙ্গিতে মাঠে আসার ছবি আজও মনে-গাঁথা ক্রিকেট বিশ্বের। হেলাফেলার চাউনি ছুড়ে, হেলমেটহীন একটা বলিষ্ঠ শরীর, যেভাবে করুণার চোখে তাকাতে তাকাতে হাতের ভারি ব্যাটটা নিয়ে ড্রেসিংরুম থেকে মাঠে পা রাখতো, মনে হত, চারপাশে যেন একটা আত্মবিশ্বাসের অদৃশ্য আলোর বলয় ঘিরে আছে তাঁকে। হ্যাঁ, এই হলেন স্যার আইজ্যাক ভিভিয়ান আলেকজান্ডার রিচার্ডস। ‘উইজডেন’ যাঁকে সর্বকালের সেরা পাঁচ ক্রিকেটারদের (বাকিরা হলেন ডন ব্র্যাডম্যান, জ্যাক হবস, গারফিল্ড সোবার্স, শ্যেন ওয়ার্ন) সংক্ষিপ্ততম তালিকায় রেখে মান্যতা দিয়েছে ।
টেস্ট ক্রিকেটে বার তিনেক ভিভকে ইডেনে নামতে দেখেছি। ১৯৭৪-৭৫ সিরিজে দুই ইনিংসে রান ছিল ১৫ আর ৪৭। দ্বিতীয় দফায় একটি অতুলনীয় কভার-ড্রাইভ এবং একটি ক্লাসিকাল অন-ড্রাইভে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ভারতের জেতার পথ ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভেবে দর্শকদের কেউই বোধহয় চাননি ভিভ ভয়ানক হয়ে উঠুন। আর ১৯৮৩-৮৪ সিরিজে ইডেনে কপিলদেবের বলে মাত্র ৯ রানে ‘কট বিহাইন্ড’ হন ।
ভিভের মেজাজের কথাটা একটু বলে রাখি। আশির দশকের শেষ দিকে ইডেনে নেহেরু কাপ ফাইনালে মুখোমুখি ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর পাকিস্তান। ম্যাচের আগের দিন নেট প্র্যাকটিস সেরে খালি গায়ের ওপরে একটা তোয়ালে ফেলে ক্লাবহাউসের সামনের ছোট্ট লনে বেতের চেয়ার টেনে সবে বসেছেন। ফটোগ্রাফার বন্ধুদের সঙ্গে আমরা কয়েকজন সাংবাদিক কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কড়া ম্যান-মার্কিংয়ে রেখেছি ভিভকে। যদি কিছু বলেন-টলেন। ইতিমধ্যে নানা বয়সী কিছু লোক কিভাবে আমাদের কাজের পরিধি কমিয়ে ভিভের কাছাকাছি চলে এসেছে টেরও পাইনি। বিরক্ত ভিভ বার দুয়েক হাত তুলে আঙুল নাড়িয়ে তাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেও কাজ হয়নি। এর মধ্যেই একজন লোক অটোগ্রাফ নেবার জন্য হামলে গিয়ে পড়ল ভিভের প্রায় গায়ের ওপর। ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড ক্ষিপ্ত ভিভ খাতাসহ হাতটা সজোরে ঠেলে দিয়ে যা বললেন তার বাংলা করলে দাঁড়ায়—“হ্যালো মিস্টার, আমি যদি কারও অটোগ্রাফ চাইতে যাই, তাহলে তাঁকে গিয়ে বলি ‘স্যার, আপনি কি অনুগ্রহ করে আমাকে একটা অটোগ্রাফ দিয়ে বাধিত করবেন?” ঘটনাটা বললাম এটা বোঝাতেই, যে অন্তরে রাগ পুষে রাখলে সেটা কতখানি বিস্ফোরক হতে পারে সেই মেজাজ দেখেছিলাম। বিশ্বের সব ক্যাপ্টেনই জেনে গিয়েছিলেন তাঁকে ‘স্লেজ’ করলে তার প্রতিক্রিয়া কী মারাত্মক হতে পারে। একবার সমারসেটের হয়ে ব্যাট করতে এসেছেন ভিভ। গ্ল্যামোরগনের বোলার গ্রেগ টমাস বার কয়েক ‘বিট’ করেই এগিয়ে এসে জীবনের চরম নির্বোধতম কাজটি করলেন—“কী হে, বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে? এটা লাল ক্রিকেট বল, শক্ত, পাঁচ আউন্স ওজন।” পরের বলই সোজা মাঠের বাইরে পাঠিয়ে ভিভ পাল্টা বললেন “তুমি তো ভালোই জানো বলটা কেমন দেখতে। তুমিই বরং যাও, বলটা খুঁজে নিয়ে এসো।”
খুনে মেজাজের ভিভ রিচার্ডস নির্দয়ভাবে বোলারদের থ্যাঁৎলাতেন। ১৯৮৪ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে একদিনের ম্যাচে ভিভ যখন ব্যাট করতে নামেন তখন দলের রান ১১/২। একটা সময় উইলিস, বথাম, প্রিঙ্গল, ফস্টারদের বলে ছিন্নভিন্ন ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান দাঁড়াল ১০২/৭। এল্ডিন ব্যাপটিস্টকে নিয়ে ৫৯ রান জুড়লেন ভিভ। অল্প ব্যবধানে ফিরে গেলেন ব্যাপটিস্ট এবং গার্নার। এবার মরণ-বাঁচন ম্যাচে পাল্টা মার শুরু করলেন ভিভ। শেষ উইকেটে মাইকেল হোল্ডিংকে (১২ নট আউট) নিয়ে দলের রান পৌঁছে দিলেন ২৭২/৯। ৫টা ছক্কা, ২১টা বাউন্ডারি হাঁকিয়ে নিজে করলেন ১৮৯। এটাই স্বীকৃতি পেয়েছে ‘একদিনের ক্রিকেটের সব-সেরা ইনিংস’ হিসাবে। আর ১৯৮৫ সালে ওয়ারউইকশায়ারের বিরুদ্ধে চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচের ইনিংসটা তো ছিল জাস্ট ‘ঝড়’। নর্মান গিফোর্ড, গ্ল্যাডস্টোন স্মলের মতো বোলারদের পিটিয়ে ‘মাস্টার ব্লাস্টার’ একদিনে করেছিলেন ৩২২ রান (৮টি ছক্কা আর ৪২টি বাউন্ডারি)! ১৯৮৬ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কম বলে (৫৬) তাঁর টেস্ট সেঞ্চুরি করার কীর্তিটি দীর্ঘদিন ছিল এক নম্বরে। ১৯৭৫ এবং ১৯৭৯ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পিছনেও ভিভের ভূমিকা ভোলার নয়। ১৯৭৫-এ গ্রেগ চ্যাপেল, ইয়ান চ্যাপেল এবং অ্যালান টার্নারকে রান আউট করেছিলেন। আর ১৯৭৯ ফাইনালে তো অনবদ্য ১৩৮ এসেছিল ‘কিং’ রিচার্ডসের ব্যট থেকে। ১৯৯৯ সালে ‘নাইটহুড’ পাওয়া ভিভের নামেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ-ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজের বিজয়ীকে দেওয়া হবে ‘রিচার্ডস-বথাম ট্রফি’, যা ২০২০ সালের পর থেকে ‘উইজডেন ট্রফি’-র পরিবর্ত হিসেবে চালু হতে চলেছে।
জীবনে অধিনায়ক হিসাবে কোনও সিরিজ না-হারা, বিশ্বের সবচেয়ে ভয়-ধরানো ব্যাটার, ‘হিটিং অ্যাক্রস দ্য লাইন’ এর লেখক, ‘স্মোকিং জো’ নামে খ্যাত চির নবীন ভিভিয়ান রিচার্ডস আজ পা দিলেন ৭০-এ ।