১০ মার্চ ১৯৮৫

টাইমমেশিনে আজ ঠিক ৩৭ বছর পিছনে যাচ্ছি, ভারতীয় ক্রিকেটের এক উজ্জ্বল দিনকে ফিরে দেখতে।

দিনটা ছিল রবিবার। ১০ মার্চ ১৯৮৫। সুনীল গাভাসকারের অধিনায়ক হিসেবে এদিনই ছিল শেষ ম্যাচ। মেলবোর্নের এম সি জি-তে ফাইনালে ৮ উইকেটে জিতে পাকিস্তানকে উড়িয়ে দিয়ে বেনসন-হেজেস বিশ্ব সিরিজ চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফি জিতেছিল ভারত ওইদিন। 

ছবি : গুগল

এই ম্যাচের আগের দিন এক পাক ক্রিকেটারকে জনৈক ইংরেজ সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল – “কারা জিতবে?” উত্তর পান – “আমাদের উপমহাদেশের ব্যাপার। আমরাই বুঝে নেব। আপনি আসতে পারেন।” ওই ক্রিকেটারের নাম? পাকিস্তানের ব্যাটিং মায়েস্ত্রো জাহির আব্বাস।

সাতটি দেশকে নিয়ে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫-তে শুরু হওয়া টুর্ণামেন্টে “এ” গ্রুপে ছিল ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ড। আর “বি” গ্রুপে ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড আর শ্রীলঙ্কা।

গ্রুপ “এ”-র প্রথম ম্যাচে ২০/০২/১৯৮৫-তে পাকিস্তানকে (৪৯.২ ওভারে ১৮৩) ৬ উইকেটে হারায় ভারত (৪৫.৫ ওভারে ১৮৪/৪), মূলত আজহারউদ্দিনের অপরাজিত ৯৩ আর রজার বিনির ৪/৩৫-এ ভর দিয়ে। গ্রুপ “এ”-র দ্বিতীয় ম্যাচে ২৬/০২/১৯৮৫-তে ভারত (৫০ ওভারে ২৩৫/৯) ইংল্যান্ডকে (৪১.৪ ওভারে ১৪৯) উড়িয়ে দেয় ৮৬ রানে, কৃষ্ শ্রীকান্ত-এর ৫৭ আর রবি শাস্ত্রীর ৩/৩০ ছিল উল্লেখ্য। গ্রুপ “এ”-র তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে ০৩/০৩/১৯৮৫-তে অস্ট্রেলিয়াকে (৪৯.৩ ওভারে ১৬৩) কার্যত পর্যুদস্ত করে দিয়েছিল ভারত (৩৬.১ ওভারে ১৬৫/২), কৃষ্ শ্রীকান্ত-এর নজরকাড়া ৯৩ আর রজার বিনির ৩/২৭ ছাড়া যা সম্ভব ছিলনা।

ছবি : গুগল

গ্রুপ “বি” থেকে সেমিফাইনালে ওঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর নিউজিল্যান্ড, দু’দলই হারিয়ে দেয় শ্রীলঙ্কাকে, যথাক্রমে ৮ উইকেটে আর ৫১ রানের ব্যবধানে, ২৭/০২/১৯৮৫ আর ২৩/০২/১৯৮৫ তারিখে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর নিউজিল্যান্ডের মধ্যে খেলা বৃষ্টির জন্য পরিত্যক্ত হয় ১৯/০২/১৯৮৫-তে।

গ্রুপ “এ”-তে তিনে তিনটি ম্যাচই জিতে ভারত সেমিফাইনালে পায় কিউয়িদের। দিলীপ বেঙ্গসরকারের ৬৩*, কপিলের ৫৪* আর মদনলালের ৪/৩৭য়ের জন্য ০৫/০৩/১৯৮৫-র সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ড (৫০ ওভারে ২০৬) ৭ উইকেটে হেরে যায় ভারতের (৪৩.৩ ওভারে ২০৭/৩) কাছে। 

আর তারপরে ১০/০৩/১৯৮৫-র মেলবোর্নের ফাইনালে পাকিস্তানকে (৫০ ওভারে ১৭৬/৯) ৮ উইকেটে উড়িয়ে দিয়ে বেনসন-হেজেস বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ কাপ জিতে নিয়েছিল ভারত (৪৭.১ ওভারে ১৭৭/২), অবিসংবাদী উইনার হিসেবে। টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিং নেয় পাকিস্তান। ১৩ ওভারে ৪ উইকেটে ৩৩। ফিরে গেছেন মুুদাস্সর, মহসীন, রামিজ আর ওমর। তিন উইকেট তুলে কপিলদেব ফাইনালটা তাহলে শেষ করে দিলেন শুরুতেই? না এবং না। এরপর ইমরানের বিরুদ্ধে জোরালো একটা রান-আউট আবেদন বাতিল হবে। ৫ম উইকেটে ৬৮ তুলবেন ইমরান-জাভেদ। ৬ষ্ঠ উইকেটে ৩০ তুলবেন সেলিম-জাভেদ। ৪৯ ওভারে ১৬৩/৯ রানে পৌঁছবে পাকিস্তান। উইকেটে তখন ওয়াসিম রাজা-আজিম হাফিজ। সাড়ে তিন ঘন্টা থেকে ২৫ মিনিট পিছিয়ে সময়। শাস্ত্রী-শিবরাম ১৯ ওভার দ্রুত করে দেবার সুবাদে। আর ৫ মিনিটের মধ্যে পাকিস্তান অলআউট হলে নামতে হবে ভারতকে লাঞ্চের আগেই। শাস্ত্রী-শ্রীকান্ত সেটা চাইছেন না, স্বাভাবিকভাবেই।

৫০-তম ওভারটি বল করার কথা চেতন-এর। কিন্তু ক্যাপ্টেন ডাকলেন রবি শাস্ত্রীকে। দুলকি চালে ডিপ ফাইন লেগ থেকে ১ মিনিট সময় নিয়ে এলেন শাস্ত্রী। এবং ১ মিনিট পরে ফিরে গেলেন নিজের জায়গায়। আবার ১ মিনিট সময় নিয়ে। ক্যাপ্টেন মত পাল্টানোয়। এবার ডাকা হল লক্ষ্মণ শিবরামকৃষ্ণণকে। তিনিও এলেন দুলকি চালেই। ডিপ থার্ডম্যান থেকে।  দেড় মিনিট গেল আরো। বল নিয়ে শিবরামকৃষ্ণণ যখন রান আপে যখন পৌঁছলেন, ৫ মিনিট শেষ ততক্ষণে। ৫০ ওভারের শেষে পাকিস্তান ১৭৬/৯। পুরো টুর্ণামেন্টে এই প্রথম কোন টিম অল-আউট হ’লনা ভারতের বিরুদ্ধে। কেননা ফাইনাল ছাড়া চারটি ম্যাচেই প্রতিপক্ষকে অল-আউট করে দিয়েছিল ভারত। তারপর শাস্ত্রী-শ্রীকান্ত লাঞ্চের পরে অনায়াসে জিতে নিলেন ফাইনাল। আগের ঘোষণামত ঐ বেনসন-হেজেস জিতেই সেদিন অধিনায়কত্ব ছেড়েছিলেন ক্যাপ্টেন।

এই ক্যাপ্টেন্সি আসলে জিতিয়ে দিয়েছিল ক্রিকেটকে। এই ক্যাপ্টেন্সি লোকগাথা থেকে গেছে ভবিষ্যতের জন্য। এই ক্যাপ্টেন্সি জানিয়ে দিয়েছিল, মাঠে গিয়ে যারা শুধু খেলাই দেখেন, তাঁরা ক্রিকেটের কিছুই দেখেননা। আর ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছিল সুনীল গাভাসকারের এই ক্যাপ্টেন্সি।

ওইদিন ‘ম্যান অফ দি টুর্নামেন্ট’ হয়ে “অডি” গাড়ী পেয়েছিলেন রবি শাস্ত্রী। অবশ্য আলাদা করে কেউ নয় – সেবার বেনসন-হেজেস কাপ জিতেছিল “টিম ইন্ডিয়া”। খেলাশেষে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অধিনায়ক সানির টিভি-র পর্দা ফাটানো “ব্যারিটোন” গলার শব্দটা আজও শোনা যায় অতীতে কান পাতলে আর সেটা পুনরোচ্চারিত হতে থাকে মনের মধ্যে।

ছবি : গুগল

তখন ক্রিকেট ছিল ভদ্রলোকের খেলা। তখন ক্রিকেট ছিল বীরত্বের খেলা। তখন ক্রিকেট ছিল আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচার খেলা। তখন ক্রিকেট ছিল নিখাদ ভালোবাসার খেলা।

ভারতীয় ক্রিকেট দীর্ঘজীবী হোক।