[পূর্বকথা]
আসন্ন কবিপক্ষের প্রাক্কালে রবিঠাকুরের সচিবসম অমিয় চক্রবর্তীর “মেলাবেন তিনি মেলাবেন” স্মরণ করে – মে মাস, ক্রিকেট আর ব্যাটিংয়ের দাপট – এই তিনটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে-থাকা বিন্দুকে মেলাবার একটা চেষ্টা করি, আইপিএলের মধ্যে না ঢুকেই। সম্ভব নয়, বলছেন? আমি বলছি সম্ভব, দেখা যাক!
একটা খানদানি ব্যাটিং রেকর্ডের কথা অনেক ক্রিকেট-প্রেমীই হয়ত জানেন যেটা আজ পর্যন্ত মাত্র আটজন ক্রিকেটার অর্জন করতে পেরেছেন – রেকর্ডটা হয়েছে মাত্র ন’বার। হ্যাঁ, আমি বলছি ইংলিশ ক্রিকেটে এক মরশুমে “মে মাসের মধ্যে হাজার রান” করবার কৃতিত্বের কথা। মনে পড়ছে সে কথা?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সাড়ে-সাত দশকেরও বেশি সময়কালে এই রেকর্ড হয়েছে মাত্র দু’বার, করেন – গ্লেন টার্নার (১৯৭৩ সালে ১৮ ইনিংসে) এবং গ্রেম হিক (১৯৮৮ সালে ১১ ইনিংসে)। এই দু’জন “হাজারী” ব্যাটারেরই জন্ম ইংল্যান্ডের বাইরে, অর্থাৎ ‘বিদেশি; আর দু’জনেরই জন্ম মে মাসে, অর্থাৎ ‘মে মাসের জাতক’।
আগের পর্বে এঁদের প্রথমজনকে নিয়ে লিখেছি, এই পর্বে লিখি দ্বিতীয় জনকে নিয়ে। আসুন, শুরু করা যাক।
গ্রেম হিক জন্মেছিলেন রোডেশিয়াতে (বর্তমানের জিম্বাবোয়ে) ১৯৬৬ সালে। অনেকেই হয়ত জানেন না যে ১৯৮৩ বিশ্বকাপে কপিলদেব যখন তাঁর প্রবাদপ্রতিম ১৭৫* ইনিংসটা খেলছিলেন, তখন বিপক্ষদলের অতিরিক্তদের বেঞ্চে বসে ১৭ বছরের (সেই বিশ্বকাপের সর্বকনিষ্ঠ) যে ক্রিকেটারটি সেই বিধ্বংসী ব্যাটিং দেখেছিলেন তাঁরই নাম গ্রেম হিক – সেই বিশ্বকাপের জিম্বাবোয়ের ১৪ জনের দলে তিনি ছিলেন যদিও সেই প্রতিযোগিতায় কোনও ম্যাচেই তিনি খেলেননি।
১৯৮২-৮৩ মরশুমে জিম্বাবায়ে সফরকারী তরুণ অস্ট্রেলিয়ানদের বিরুদ্ধে এক ম্যাচে তিনি মুখোমুখি হন ডীন জোন্স ও স্টিভ ওয়-র, এবং জোনস-কে বোল্ড আউট করেন – পরবর্তীকালে এই প্রসঙ্গে ওয় নাকি বলেন: “Hick was as good a player as anyone of that age in the history of cricket.” ১৯৮৪ সালের গ্রীষ্মকালে জিম্বাবোয়ে বোর্ডের থেকে এক ক্রিকেটীয়-বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ডে গিয়ে উরস্টারশায়ার কাউন্টির দ্বিতীয় একাদশের হয়ে খেলা শুরু করেন, এবং সেই মরশুমেরই শেষের দিকে প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচে খেলবার সুযোগও পান। শীতকালে তিনি জিম্বাবোয়েতে খেলা চালিয়ে যান। এমনই চলতে থাকে পরবর্তী কয়েক বছর। ১৯৮৫ থেকে শুরু ক’রে পরপর ছ’টা ইংলিশ কাউন্টি মরশুমের পাঁচটাতে প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচে তাঁর ব্যাটিং গড় ছিল ৫০-বা-তার-বেশি। ১৯৮৬ সালে তরুণতম ব্যাটার হিসেবে এক মরশুমে তিনি দু’হাজার প্রথম-শ্রেণীর রান তোলেন। ১৯৮৭ মরশুমে তিনি উইজডেন-এর “Cricketers of the Year” হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন, তখন তাঁর প্রথম-শ্রেণীর ব্যাটিং গড় ষাটেরও বেশি, ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেটে তিনি তখন উদীয়মান সূর্য।
তারপর এল সেই ১৯৮৮-র মরশুম – ১৯৭৪ সালের ১৪ বছর পরে উরস্টারশায়ার কাউন্টি চ্যাম্পিয়ন হ’ল – আর মে মাসের মধ্যে হাজার রান পূর্ণ করে হিক ছুঁলেন গ্রেস-হ্যামন্ড-ব্র্যাডম্যান এর মতন দিকপালদের। এরই মধ্যে মে’র প্রথম সপ্তাহে খেললেন তাঁর জীবনের সর্বোচ্চ প্রথম-শ্রেণীর ইনিংস, সমারসেটের বিপক্ষে করলেন ৪০৫ – ১৪ বছরেরও বেশি সময় বাদে প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচে ব্যক্তিগত ৪০০-বা-তার-বেশি রানের ইনিংস খেলা হ’ল – ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে আফতাব বালোচ ৪২৮ করেছিলেন। এই মাপের প্রথম-শ্রেণীর ইনিংসের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াল আট – আর্চি ম্যাকলারেন (১৮৯৫-তে ৪৩৪), বিল পন্সফোর্ড (১৯২৩-এ ৪২৯ ও ১৯২৭-এ ৪৩৭), ডন ব্র্যাডম্যান (১৯৩০-এ ৪৫২*), বি বি নিম্বলকর (১৯৪৮-এ ৪৪৩*), হানিফ মহম্মদ (১৯৫৯-এ ৪৯৯ রান-আউট) – হিক হলেন বিশ্বের সপ্তম ব্যাটার। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি এর পরবর্তী প্রায় পঁচিশ বছরে এমন ইনিংস খেলা হয়েছে আরো মা্ত্র দুটো – খেলেছেন আরেক ‘মে মাসের জাতক’, ব্রায়ান লারা (১৯৯৪-তে ৫০১* ও ২০০৪-এ ৪০০*), এই একদম শেষেরটা টেস্ট-ম্যাচে।
১৯৯১ সালে এল সেই বছর যার জন্য এতদিন ধরে ইংল্যান্ডের প্রায় সমস্ত ক্রিকেট-প্রেমী উদগ্রীব ছিলেন – ‘বিদেশি’ গ্রেম হিক ইংল্যান্ডের জাতীয় দলে খেলবার অনুমতি পেলেন, সফরকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের বিরুদ্ধে, মে মাসে তিন-ম্যাচের ওডিআই সিরিজে ও জুন-জুলাইতে পাঁচ-ম্যাচের টেস্ট সিরিজে। ওডিআই-তে শুরুটা ভালই হ’ল (১৪, ২৯, ৮৬*), দলের ৩-০ সিরিজ জয়। কিন্তু প্রথম চার টেস্টে সাত ইনিংসে – ৬, ৬, ০, ৪৩, ০, ১৯, ১ – মোট ৭৫ রান, এবং ভিভের ক্যারিবিয়ান পেস-ব্রিগেড (অ্যামব্রোজ-মার্শাল-প্যাটারসন-ওয়ালশ-অ্যালেন) তাঁকে ভালভাবেই সমঝে দিলেন টেস্ট-ক্রিকেট কি জিনিস, বাদ পড়লেন পঞ্চম-তথা-শেষ টেস্ট একাদশ থেকে।
গুঞ্জন উঠল তাঁর সম্বন্ধে ১৯৯০ সালে নিউজিল্যান্ডের অফ-স্পিনার জন ব্রেসওয়েল যা বলেছিলেন: “a flat-track bully”, তার যথার্থতা নিয়ে। পরের দুই টেস্ট-সিরিজেও নড়বড়ে অবস্থা – নিউজিল্যান্ডে গিয়ে ৩৫, ৩০, ৪, ৪৩, ২২ আর ইংল্যান্ড-সফরকারী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৫১, ১৩, ১১, ২২, ১ – অর্থাৎ প্রথম ১১ টেস্টে ৩০৭ রান (সর্বোচ্চ ৫১) গড় ১৮.০৫, একটা অর্ধশতরান। প্রশ্ন উঠে গেল নবাগত এই ডান-হাতি ওয়ান-ডাউন ব্যাটারের টেস্ট-পর্যায়ের পেস-বোলিং খেলবার দক্ষতা নিয়েই। এই প্রশ্নই তাঁকে ‘মার্কামারা’ বানিয়ে দেয়। সমগ্র টেস্ট-জীবনে, তিন (৩৫ বার), চার (১৬), পাঁচ (৩৫), ছয় (১৪), এমনকি সাত (১২) নম্বরে নেমেও খুব বিশেষ হেরফের হয়নি। মানসিকতার সমস্যা? কে জানে!
সন্দেহের সেই যে শুরু, তার জের টেনেই পরবর্তী এক দশক, ২০০১ সালের মার্চের শ্রীলঙ্কা সফর পর্যন্ত, ইংল্যান্ডের টেস্ট একাদশে তাঁর ‘in-and-out’ গতিবিধি – ৬৫ ম্যাচে ১১৪ ইনিংসে ৩,৩৮৩ রান (সর্বোচ্চ ১৭৮) গড় ৩১.৩২, ছ’টা শতরান, ১৮টা অর্ধশতরান, ৯০টা ক্যাচ (মূলত স্লিপ-ফিল্ডার হিসেবে), ২৩টা উইকেট (‘অতিথি-শিল্পী’ অফ-স্পিনার হিসেবে) – এখানেই সীমিত হয়ে থেকে যায়। তাঁর সম্বন্ধে আরেকটি মূল্যায়নসূচক মন্তব্য বেশ প্রচলিত: “He (Hick) was a gentle giant who murdered medium pace and occasionally savaged the spinners.”
ওডিআইতেও তেমন বিশেষ সাফল্য নেই – ১২০ ম্যাচে ৩,৮৪৬ রান (সর্বোচ্চ ১২৬*) গড় ৩৭.৩৩, স্ট্রাইক-রেট ৭৪.০৮, পাঁচটা শতরান, ২৭টা অর্ধশতরান, ৬৪টা ক্যাচ, ৩০টা উইকেট – এই পর্যন্ত; উল্লেখযোগ্য সাফল্য ১৯৯৮-৯৯ মরশুমে অস্ট্রেলিয়াতে কার্লটন-ইউনাইটেড ত্রিপাক্ষিক সিরিজে – শ্রীলঙ্কা ছিল তৃতীয় দল – ১২ ইনিংসে তিনটে শতরান সমেত ৫১৩ রান। ১৯৯২, ১৯৯৬ ও ১৯৯৯ তিনটে বিশ্বকাপে ২০ ম্যাচে ১৯ ইনিংসে মোট ৬৩৫ রান (সর্বোচ্চ ১০৪*), গড় ৪২.৩৩, স্ট্রাইক-রেট ৭৪.৮৮, একটা শতরান, ছ’টা অর্ধশতরান – অসাধারণ কিছুই নয়।
হিক-গাথা শেষ করি একটা বৃহৎ বৈপরীত্য দেখিয়ে। ওঁর প্রায় আড়াই শতকব্যাপী [১৯৮৩-৮৪ মরশুম থেকে অগাস্ট-২০০৮ – এর মধ্যে ১৯ বার ইংলিশ মরশুমে তিনি হাজার রান করেন] সম্পূর্ণ প্রথম-শ্রেণীর পরিসংখ্যান – ৫২৬ ম্যাচে ৮৭১ ইনিংসে ৪১,১১২ রান (সর্বোচ্চ ৪০৫*), গড় ৫২.২৩, ১৩৬টা শতরান, ১৫৮টা অর্ধশতরান, সঙ্গে ৭০৯টা ক্যাচ ও ২৩২টা উইকেট – রীতিমত গৌরবজনক। কেন এমন বৈপরীত্য? এর উত্তর অবশ্যই আছে, তবে সেটা আলোচনা করবার সুযোগ এখানে নেই। ওঁকে তাই বলা হয়: “a cherished English enigma with a remarkable first-class career.”