জেন্টলম্যান’স গেম? ধুস্ ধুস্। এঁদের কান্ডকারখানা দেখতে দেখতে ঘেন্না ধরে গেল। প্রশ্ন জাগে, খেলাটা কি আদৌ ভদ্রলোকদের। এই যে ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে রোজ সকালে তাদের বাবা–মায়েরা ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্পে নিয়ে যান, তাদের অধিকাংশই নাকি ‘বিরাট কোহলি’ হতে চায়। হায়, ভাবলেই কষ্ট হচ্ছে। কী স্বপ্নের পেছনেই না ওরা ছুটছে! আইডলের শুধু ক্রিকেটীয় পারফরমেন্সই দেখে না ছোটরা, তাদের সামনে দৃষ্টান্ত হতে পারে ‘মানুষ’টাও, যাঁর মান ও হুঁশ দুই–ই আছে।
বিরাট, আপনি এই প্রজন্মকে কী শেখাচ্ছেন? মাঠে ব্যাট হাতে আপনার আগ্রাসন অনেকেরই ভাল লাগে। কিন্তু আপনার আচরণে যে সর্বগ্রাসী আগ্রাসন দেখা যাচ্ছে, তা কষ্ট দিচ্ছে এই ভারতের তামাম ক্রিকেটপ্রেমীদের। মাঝে অনেক ক্ষেত্রেই মনে হচ্ছিল আপনি পাল্টে যাচ্ছেন। টেস্টে শতরান না পাওয়ার দীর্ঘ অপেক্ষা যখন কাটল, বিরাটকে আমরা একেবারে অন্য রূপে পেয়েছিলাম। উল্লাসে ফেটে পড়া নয়, বরং শান্ত, স্নিগ্ধ হাসিতে মন কেড়েছিলেন প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক। বলা হচ্ছিল আপনার এই পাল্টে যাওয়ার পেছনে বিরাট ভূমিকা রয়েছে স্ত্রী অনুষ্কা শর্মার। ইদানিং একাধিকবার দেশের নানা মন্দিরে সস্ত্রীক বিরাটকে দেখা গেছে। তাহলে আবার কী হল? ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা পোকাটা কি আবার জেগে উঠল? চলতি আইপিএলে আপনার ব্যাটে ছন্দ আছে। তার মানে এই নয় যে, আগ্রাসী মেজাজে সবাইকে ছাপিয়ে যেতে হবে? একটি ম্যাচে বিপক্ষের ব্যাটার আউট হতেই যেভাবে সেলিব্রেশনে মেতে উঠলেন, তা নিঃসন্দেহে দৃষ্টিকটূ। ফল? পরের দিনই শাস্তি। জরিমানার কবলে। কিন্তু আপনি থামার পাত্র নন। দলের বোলারের সঙ্গে বিপক্ষ ব্যাটারের ঝামেলা। কোথায় আপনি অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে সেই ঝামেলা মেটাবেন, তা নয়, ‘নবীন’ ক্রিকেটারকে আরও উত্যক্ত করলেন!
গৌতম গম্ভীর দেশের ক্রিকেটে বড় নাম। দেশের বিশ্বকাপ জয়ে বড় অবদান রয়েছে। এখন দেশের সাংসদ। লখনউ ফ্র্যাঞ্চাইজির মেন্টর। কিন্তু তাঁরও যা আচরণ আমরা দেখলাম, বিরক্তির উদ্রেক হবেই। কী যে শেখাচ্ছেন এঁরা! এই গম্ভীরই একবার নিজের ম্যাচের সেরার পুরস্কার দিয়ে দিয়েছিলেন বিরাটকে। কী কারণে তাঁদের সম্পর্কের অবনতি, তা জানার কোনও আগ্রহ নেই আমজনতার। কিন্তু সেটা তাঁরা ঢাক পিটিয়ে মানুষকে জানাবেন কেন? একবার নয়, বারবার বোঝাবেন তাঁদের সম্পর্ক কতটা তলানিতে পৌঁছেছে!
দু’জনকেই শাস্তি দিয়েছে বিসিসিআই। ম্যাচ ফি–র ১০০ শতাংশ জরিমানা হয়েছে। কিন্তু ভারতের অনেক প্রাক্তনই দাবি করছেন এই শাস্তিতে হবে না, চাই কঠোর শাস্তি। এই জরিমানা সংশ্লিষ্ট ক্রিকেটার দেবেন না, দেবে তাঁদের ফ্র্যাঞ্চাইজি। চাই নির্বাসনের মতো শাস্তি। সুনীল গাভাসকার পরিষ্কার বলছেন, অন্তত দুই ম্যাচ নির্বাসিত করা উচিত ছিল বিরাটদের। তাহলে অন্তত একটা বার্তা যেত। কিন্তু অর্থের নেশায় বুঁদ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কর্তারা কি পারবেন এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে? বোধ হয় না।
তবে এই লেখা শেষ করব আশার আলো নিয়েই। প্রবল সমালোচিত হয়ে কি হুঁশ ফিরছে? গত শনিবার সন্ধেয় ম্যাচের আগে একটা দৃশ্য মন অবশ্যই ভাল করেছে। মাঠে ওয়ার্মআপ করতে নেমে ছোটবেলার কোচের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন বিরাট। ছাত্রের পিঠে স্নেহের হাত রাখলেন গুরু। সেই ম্যাচের পর দ্বিতীয় দৃশ্য সাম্প্রতিক এত বিরক্তির মধ্যে একটু হলেও আনন্দের রেশ বয়ে এনেছে। আগের দিল্লি–বেঙ্গালুরু ম্যাচের পর প্রাক্তন বোর্ড সভাপতি, দিল্লির ক্রিকেট ডিরেক্টর সৌরভ গাঙ্গুলির সঙ্গে হাত না মেলানোর অভিযোগ উঠেছিল বিরাটের বিরুদ্ধে। বিরাট ঔদ্ধত্যের পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ফিরতি ম্যাচে দেখা গেল সৌজন্যের আবহ। সৌরভ গাঙ্গুলি কোওদিনই বিরাট সম্পর্কে কোনও নেতিবাচক মন্তব্য করেননি প্রকাশ্যে। বিরাট অবশ্য হেঁটেছিলেন উল্টো পথে। জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব হারানো নিয়ে ঘুরিয়ে তৎকালীন বোর্ড সভাপতিকে মিথ্যেবাদী প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন! গত শনিবার অতীতের সব বিতর্ক দূরে সরিয়ে সেই সৌরভই কাছে ডেকে নিলেন বিরাটকে। হাত মেলালেন। কাঁধে হাত রেখে সুসম্পর্কের উষ্ণতা ফেরানোর চেষ্টা করলেন। বিরাটও হাসিমুখে সেই উষ্ণতার ওম নিলেন। মুহূর্তেই সেই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। এই ছবি আবার দেখিয়ে দিল ক্রিকেটে অসভ্যতার কোনও জায়গা নেই। যে খেলা এদেশের জনতার শিরায়–উপশিরায় বয়ে চলে, সেই খেলায় এমন মন ভাল করা ছবি, সৌজন্যের বার্তা প্রতিদিন আসুক। খেলাটা ভদ্রলোকের, প্রমাণ করার দায় ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকের।