একদিকে চলছে আইপিএলের নিলাম। তিনি তখন সুদূর গুয়াহাটিতে, কোয়ারেন্টিনে। হোটেলের টিভিতে দেখলেন তাঁর অন্যান্য সতীর্থদের দর উঠছে ২ কোটি, কারও আবার দেড় কোটি। তিনি সদ্য বিশ্বকাপ জিতে ফেরা দলের অধিনায়ক। অথত, তাঁর কিনা দর উঠল মাত্র ৫০ লাখ! হোটেলের বদ্ধ ঘরেই নিশ্চয় মনে মনে একটা বাড়তি তাগিদ তৈরি হয়েছিল যশ ধুলের। কী জানি, সেই তাগিদ থেকেই হয়ত জ্বলে উঠলেন।
বয়স এখন সবে আঠারো। এই বয়সের ছেলেরা এখন উচ্চ মাধ্যমিকের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অথচ, দিল্লির এই উঠতি ক্রিকেটার সেই পরীক্ষা আর পড়াশোনার আবহ থেকে অনেকটাই দূরে। তাঁর সামনে এসেই চলেছে নিত্যনতুন পরীক্ষা। কী আশ্চর্য, প্রতিটি পরীক্ষাতেই দারুণভাবে উতরেও যাচ্ছেন। এবার দারুণভাবে উতরে গেলেন রঞ্জি অভিষেকে। সুযোগটা এসে গেল হঠাৎ করেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে বিশ্বকাপ জিতে ফেরার পরই তড়িঘড়ি দিল্লির রঞ্জি দলের দরজা খুলে গেল। আপাতত বায়ো-বাব্লে থেকে গুয়াহাটিতেই খেলতে হবে প্রথম পর্বের কয়েকটা ম্যাচ। প্রথম ম্যাচে সামনে ছিল তামিলনাড়ু।
এমনিতে তিনি মিডল-অর্ডার ব্যাটার। বিশ্বকাপেও মিডল-অর্ডারেই ব্যাট করেছেন। কিন্তু রঞ্জিতে তাঁকে পাঠানো হল ওপেন করতে। প্রথমদিনই শতরান করে চমকে দিলেন সবাইকে। দুরন্ত সেই ১১৩ রানের ইনিংসে ছিল ভবিষ্যতের উজ্জ্বল এক স্বপ্ন। দিল্লির ৪৫২ রানের জবাবে তামিলনাড়ু করল ৪৯৪। দ্বিতীয় ইনিংসে শেষদিনে ফের ব্যাট করার সুযোগ এল দিল্লির কাছে। বোঝাই গিয়েছিল, এই ম্যাচের ফয়সালা হবে না। তাই দ্বিতীয় ইনিংসে কিছুটা ব্যাটিং প্র্যাকটিস ছাড়া বাড়তি কোনও মোটিভেশনও ছিল না। কিন্তু যশের কাছে ছিল অন্য এক তাগিদ। দ্বিতীয় ইনিংসেও ফের নিজেকে চিনিয়ে দেওয়ার সুবর্ণ এক সুযোগ। ফাঁকা মাঠে, মরা ম্যাচেও নিজেকে দারুণভাবে উদ্দীপ্ত করলেন এই তরুণ তুর্কি। শেষদিনে দিল্লির একটি উইকেটও ফেলতে পারল না তামিলনাড়ু। সারাদিন ব্যাট করে দিনের শেষে অপরাজিত ১১৩ রানে।
রঞ্জিতে অভিষেকেই দু’ইনিংসে শতরান! বহুকাল আগে এমন নজির রয়েছে দু’জন ভারতীয়ের। একজন নরি কন্ট্রাক্টর (গুজরাট), অন্যজন বিরাগ আওয়াতে (মহারাষ্ট্র)। তাঁদের ছুঁয়ে ফেললেন দিল্লির এই তরুণ। শুধু দুই ইনিংসে শতরানই নয়, দ্বিতীয় ইনিংসে সারাদিন ধরে ব্যাট করে গেলেন। বুঝিয়ে দিলেন তাঁর ধৈর্য ও সংযমও আছে। আছে চাইলে সারাদিন উইকেটে পড়ে থাকার মতো টেম্পারমেন্টও।
মাস ছয়েক আগেও কে চিনতেন এই তরুণকে! দিল্লির অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাতে আর কতটুকুই বা পরিচিতি তৈরি হয়েছিল! এশিয়া কাপের দলে হঠাৎ করেই তাঁকে অধিনায়ক ঘোষণা করা হল। ভারত যথারীতি চ্যাম্পিয়নও হল। কিন্তু এই চ্যাম্পিয়ন হওয়াকে একরকম স্বাভাবিক ঘটনা বলেই ধরে নিয়েছিল ক্রিকেট মহল। তাই তেমন উচ্চবাচ্য হয়নি। টিভি বা কাগজে তেমন জায়গাও বরাদ্দ হয়নি। এবার ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে ভারত রওনা হল যুব বিশ্বকাপ অভিযানে। একটি ম্যাচে খেলার পরই মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। একসঙ্গে হাফ ডজন ক্রিকেটারের করোনা সংক্রমণ। সেই তালিকায় ছিলেন অধিনায়ক যশও। ভরা বিশ্বকাপের মাঝেই দশদিন কাটাতে হল কোয়ারেন্টিনে। ভারত আদৌ দল নামাতে পারবে কিনা, তা নিয়েই ছিল বড় প্রশ্ন। দুর্বল প্রতিপক্ষ থাকায় সেই বাধা তখনকার মতো কাটিয়ে ওঠা গেল। কোয়ার্টার ফাইনালে সামনে বাংলাদেশ। তাদেরও না হয় হারানো গেল। কিন্তু সেমিফাইনালে তো সামনে অস্ট্রেলিয়া। এখানেই বিজয়রথ থমকে যাবে না তো! সেদিনই যেন জ্বলে উঠলেন যশ। একেবারে অধিনায়কোচিত ইনিংস বলতে যা বোঝায়, তাই। চাপের মুখে খেললেন অপরাজিত ১১০ রানের দুরন্ত ইনিংস। ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারাতে আর তেমন বেগ পেতে হয়নি। দুই ম্যাচ কম খেলেও বিশ্বকাপে যশের ব্যাট থেকে এসেছিল ২২৯ রান। আইসিসি যে বিশ্ব একাদশ বানাল, সেখানেও নেতা হিসেবে ঘোষণা হল যশেরই নাম।
বিশ্বকাপ জয়ের পর তাঁদের নিয়ে উল্লাস হবে, মাতামাতি হবে, সেটাই স্বাভাবিক। অথচ, বাড়ি ফিরে একটি রাতও থাকতে পারেননি বিশ্বজয়ী অধিনায়ক। গোটা দলকে সোজা উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হল আমেদাবাদে। সেখানে চলছিল ওয়ান-ডে সিরিজ। স্টেডিয়ামেই একপ্রস্থ সংবর্ধনা। ততক্ষণে রঞ্জি দলে তাঁর অন্তর্ভুক্তি ঘোষণা হয়ে গেছে। ফলে, আহমেদাবাদে সংবর্ধনা পর্ব মিটিয়ে পরদিন সকালে কয়েকঘণ্টার জন্য একবার বাড়িতে যাওয়া। বিকেলের মধ্যেই ফের রঞ্জি খেলতে গুয়াহাটির বিমান ধরা। এই ব্যস্ততার আবহেই কাটছে বিশ্বজয়ী অধিনায়কের। সবে আঠারো বছর। এখনই পেশাদারিত্বের এমন শক্ত বাঁধনে কে আর বাঁধা পড়তে কে চায়! এই অবস্থায় মাথা ঠান্ডা রেখে দু’ইনিংসে শতরান!
সত্যিই, একটা হিম্মৎ লাগে। আঠারোর স্পর্ধায় যেন সেই সাহসটাই অর্জন করেছেন তরুণ তুর্কি। কবিতার ভাষাতেই ফের বলতে ইচ্ছে করছে, এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।