এই বিষয়ে আগের পর্বে লিখেছি পঞ্চাশের দশকের ইয়ান ক্রেগ-কে নিয়ে। এই পর্বে আসছেন তাঁর থেকে, বয়সে প্রায় দু’বছরের এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেট-আবির্ভাবে প্রায় পাঁচ বছরের ছোট কিন্তু তাঁর প্রায় সাড়ে-ছয় বছর আগে জীবন থেকে চিরবিদায় নেওয়া নর্ম্যান ও’নীল।
নর্ম্যান ও’নীল [১৯৩৭—২০০৮]
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাটারদের অন্যতম, স্বাস্থ্যবান পেশীবহুল চেহারার সুদর্শন আক্রমণাত্মক খেলোয়াড় নর্ম্যান ও’নীল পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে ঘরোয়া ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ান দর্শকদের মন কেড়ে নেন। ১৯৫৭-৫৮ মরশুমে দেশের প্রধান খেলোয়াড়রা যখন দক্ষিণ আফ্রিকায় সফররত, সিডনি শহরের এই ২০-বছর-বয়সী ছেলেটি শেফিল্ড শীল্ড প্রতিযোগিতায় NSW-এর হয়ে মোট ১,০০৫ রান করলেন (গড় ৮৩.৭৫), মরশুম শেষ করেন ভিক্টোরিয়া রাজ্যদলের বিরুদ্ধে ৩৮টা বাউন্ডারি-সহযোগে ২৩৩ রানের এক ইনিংস খেলে। তাঁর আগে বিল পন্সফোর্ড (ভিক্টোরিয়ার হয়ে, দু’বার) এবং ব্র্যাডম্যান (দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার হয়ে) ছাড়া ঘরোয়া ক্রিকেটে আর কেউ এই কাজ করে উঠতে পারেননি।
অন্যদিকে ‘নতুন ব্র্যাডম্যান’ ক্রেগ তখন দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্যাট হাতে হালে পানি পাচ্ছেন না, পরপর কয়েকটা টেস্ট-সিরিজে বিভিন্ন দেশে তাঁর ধারাবাহিক ব্যাটিং-ব্যর্থতা নিয়ে সমর্থককুল আশাহত ও বিমর্ষ। অতএব জনমানসে অবধারিত প্রতিক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি আর এবার ও’নীল অভিহিত হলেন ‘নতুন ব্র্যাডম্যান’ নামে। তাঁর প্রায় সমস্ত ক্রিকেট-জীবন তাঁকেও এই এক বিশাল চাপ নিয়ে খেলতে হয়েছে।
লোকে ভুলে গেলেন যে চেহারায় ও মানসিকতায় ও’নীল ছোটখাট চেহারার ব্র্যাডম্যানের থেকে অনেক অন্যরকম। ব্র্যাডম্যানের নির্মম রানক্ষুধার পরিবর্তে ‘ওনীলের ছিল সৌষ্ঠবময় দৃষ্টিনন্দন আক্রমণাত্মক ব্যাটিং যার জন্য তিনি কখনও কখনও ঝুঁকিপূর্ণ শটও খেলতেন। সব মিলিয়ে ব্র্যাডম্যান-এর থেকে কিথ মিলার-এর সঙ্গেই যেন তাঁর বেশি সাদৃশ্য ছিল। মিলার-এর ব্যাক-ফুট-এর জোরদার শটগুলো ও’নীল-কে ছোটবেলা থেকেই মুগ্ধ করত। তাঁর আরেক প্রিয় খেলোয়াড় ছিলেন নিল হার্ভে। পরবর্তীকালে তিনি ও হার্ভে মিলে কভার অঞ্চলে ফিল্ডিংয়ের এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর তৈরি করেন। তাঁর ফিল্ডিং নিয়ে Wisden বলেছে “A glorious fieldsman, he has the dream throw.” প্রসঙ্গত জানাই যে ছোটবেলা থেকেই নিয়মিত বেসবল-ও খেলবার ফলে ও’নীল-এর নিখুঁত থ্রো-তে এমনই গতি-শক্তি ছিল যে তাঁকে নাকি নিউ ইয়র্ক ইয়াঙ্কিস দল তাদের পিচার ও শর্ট-স্টপ হিসেবে পেতে চেয়েছিল। তবে তিনি ক্রিকেটেই থেকে যান।
অনেকেই এটাও ভুলে যান যে প্রথম-শ্রেণীর ঘরোয়া ক্রিকেটে ও’নীলের সূচনা, ১৯৫৫-৫৬ মরশুমে, নেহাৎই সাধারণ ছিল যদিও তাঁর অতিপ্রিয় ক্রিকেটার মিলারের অধিনায়কত্বে NSW-এর হয়ে খেলতে পেরে তিনি আপ্লুত হয়ে গেছিলেন। অথচ প্রথম-শ্রেণীর অভিষেক ইনিংসে তাঁর রান ছিল শূন্য! প্রথম দুই মরশুমে তিনি নজর কাড়তে পারেননি। ১৯৫৬-৫৭ মরশুমে ও’নীল গোটাদুয়েক ষাটের-ঘরের ইনিংস খেলেন, এবং মরশুমের শেষের দিকে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে তাঁর প্রথম শতরানও পান। এরপর ক্রেগ-এর নেতৃত্বে এক বেসরকারী নিউজিল্যান্ড সফরে যান, সেখানে (তিনটের মধ্যে) একটা বেসরকারী ‘টেস্ট’ ম্যাচে সুযোগ পেয়ে শতরান (১০২) করেন এবং ঐ সফরে তাঁর ব্যাটিং-গড় ছিল দলের সর্বোচ্চ (৭২.৬৬) – তখন তাঁর বয়স সবে ১৯ পেরিয়েছে। তা সত্ত্বেও ১৯৫৭-৫৮ মরশুমে ক্রেগ-এরই নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে তারুণ্যপ্রধান জাতীয় দলে তাঁর জায়গা হয়নি। কিন্তু এটাই হয়ে উঠল শাপে বর।
১৯৫৭-৫৮ মরশুমে ভিক্টোরিয়া-র বিরুদ্ধে চার-ঘন্টায় তাঁর দর্শনীয় ২৩৩ রানের ইনিংস দেখে বিল ও’রিলি তাঁকে ‘দ্বিতীয় ব্র্যাডম্যান’ বলেন। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে তিনি বাদ পড়ায় জ্যাক ফিঙ্গলটন খেদ প্রকাশ করেন। ও’রিলি ও ফিঙ্গলটন এঁরা দুজনেই ব্র্যাডম্যান-এর সহ-খেলোয়াড় ছিলেন, ১৯২৭-২৮-২৯ সাল থেকে। কাজেই তাঁদের মন্তব্যগুলোর মূল্য অনেক গুরুত্ব পায়। প্রত্যাশার চাপের সেই শুরু!
পরের মরশুমে, ১৯৫৮-৫৯, সফররত ইংল্যান্ড দলের বিরুদ্ধে দুটো প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচে পার্থে ১০৪ ও সিডনিতে ৮৪ রানের দুটো ইনিংস সেই অ্যাশেজ-সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট-দলে ও’নীল-এর জায়গা ক’রে দেয়। ব্রিসবেন-এর প্রথম টেস্টে বিশ্রিরকম ধীরগতির খেলা হয়েছিল, ওভার-প্রতি গড়ে দেড় রানের বেশি হয়নি, ট্রেভর বেইলি সাড়ে-সাত ঘন্টা ব্যাট ক’রে ৬৮ রান করেন! এর মধ্যে ও’নীল কিছুটা প্রাণের সঞ্চার করেন, চতুর্থ ইনিংসে অবিচ্ছিন্ন তৃতীয় উইকেট জুটির ৮৯ রানের মধ্যে জোরালো স্কোয়্যার-কাট ও ব্যাক-ফুট ড্রাইভ শটের সাহায্যে তাঁর ৭১* (১১৩ মিনিট, সাতটা বাউন্ডারি) ইনিংসটা দলের জয়কে ত্বরান্বিত করে তোলে। প্রথম ইনিংসে তিনি করেছিলেন ৩৪ রান। ঐ সিরিজে তিনটে অর্ধশতরান সমেত ২৮২ রান (গড় ৫৬.৪০) ক’রে দলে তিনি জায়গা পাকা করেন। বিখ্যাত ক্রিকেট-সাংবাদিক ইয়ান পীবলস লেখেন: “Although O’Neill is in the very early stages of his career it is already something of an occasion when he comes to the wicket, and one can sense the expectancy of the crowd and the heightened tension of the opposition.” অকাল-অবসরপ্রাপ্ত ক্রেগ-র বদলে এবার প্রত্যাশার চাপ নব্য-তারকা ও’নীল-এর ওপর – সেই ‘পরবর্তী ব্র্যাডম্যান’ চাই!
১৯৫৯-৬০ মরশুমে ভারতীয় উপমহাদেশ সফরে এসে আটটা টেস্টে তিনি মোট ৫৯৪ রান করেন (গড় ৬৬.০০), তিনটে শতরান – লাহোরে ১৩৪, বম্বেতে ১৬৩, কলকাতায় ১১৩ – দল পাকিস্তানে তিন-টেস্টের সিরিজ ২-০ জেতে, ভারতে পাঁচ-টেস্টের সিরিজ ২-১ জেতে। তাঁর জীবনের প্রথম-শ্রেণীর সর্বোচ্চ ইনিংস ২৮৪ খেলেন আহমেদাবাদে ভারতীয় বোর্ড সভাপতি একাদশের বিরুদ্ধে। আকর্ষণীয় ব্যাটিংয়ের জন্য ভারতীয় উপমহাদেশে তিনি প্রভূত জনপ্রিয়তা লাভ করেন, কিছু কিছু ভারতীয় তাঁকে ‘অনিল’ নামে ডাকতে শুরু করেন।
এই প্রসঙ্গে শঙ্করীপ্রসাদ বসুর “ইডেনে শীতের দুপুর” বইটার থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃতি দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছিনা: “ব্রাবোর্ণ স্টেডিয়ামে ও’নীলের খেলা দেখে প্রভূত প্রশংসার পরেও বিজয় মার্চেন্ট ঈষৎ বিদ্রুপ না করে পারেন নি – ও’নীল নাকি ব্র্যাডম্যান! মার্চেণ্ট বলেছেন, ও’নীল যে-সময়ে সেঞ্চুরী করেছেন, তরুণ ব্র্যাডম্যান সে সময়ে তিনশো রান করে ফেলতেন। কথাটা ঠিক। ও’নীল ব্র্যাডম্যানের চেয়ে ধীর। ও’নীল বয়সের তুলনায় পরিণত। ব্র্যাডম্যানের ভ্রান্তিহীন সংহারের পরিবর্তে নীতিশীল আক্রমণই তিনি পছন্দ করেন। … তাঁকে যদি ব্র্যাডম্যানের পথবর্তী বলা হয়, সে ও’নীল খুব বড় ব্যাটসম্যান, এই কথাটি বোঝাবার জন্য ৷ ব্র্যাডম্যান আধুনিক ক্রিকেটের মানদণ্ড। … ব্র্যাডম্যানের খেলায় শেষ পর্যস্ত একটা ‘আদিমতা’ ছিল, প্রতিভাবেষ্টিত যে আদিমতা পৃথিবীকে জয় করল সবলে। … নর্ম্যান ও’নীলের মধ্যে আছে ভারসাম্য, বৈজ্ঞানিকতা, ছন্দ-জ্ঞান,, নিয়মতান্ত্রিকতা ও আত্মস্থতা। … শেষ কথা, ও’নীলের ইনিংসের মধ্যে সবচেয়ে বেশী চোখে পড়েছে তাঁর সময়জ্ঞান। ও’নীলের (মারা) বল যখন বিদ্যুৎগতিতে বাউন্ডারিতে ছুটেছে, তখনও ব্যাটে যে শব্দ বেজেছে তা আশ্চর্য রকমের কোমল ও মৃদু। ও’নীল সম্বন্ধে আরো একটি কথা – তিনি দর্শকচিত্তে কল্পনার উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারেন নি। ক্রটিহীন অভিব্যক্তিতে তিনি দর্শককে মুগ্ধ করেছেন, কিস্তু উত্তেজিত করতে পারেননি দুঃসাহসে। … ও’নীলের খেলা দেখে একটি অভাবের কথা মনে হয়েছে – তাঁর সামনের পায়ে মারের স্বল্পতা। ও’নীল মূলত পিছন-পায়ের খেলোয়াড়। তবে জাত খেলোয়াড় বলে সামনের পায়ে ষখন মেরেছেন, অমর মুহূর্তের সৃষ্টি সেগুলি।“ – ইডেনে শতরানের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর ব্যাটিং-শৈলী নিয়ে এমন বিশ্লেষণ বিরল।
১৯৬০-৬১ মরশুমে ব্রিসবেনের সেই ‘টাই-টেস্টে’ তিনি ছিলেন ম্যাচের সর্বোচ্চ রানকারী (২০৭=১৮১+২৬) – তাঁর প্রথম ইনিংসের ১৮১ (৪০১ মিনিট, ২২টা বাউন্ডারি) করতে তাঁকে লড়তে হয়েছিল বিপক্ষের ৪৫৩ রানের বোঝা নিয়ে হল-ওরেল-সোবার্স-ভ্যালেন্টাইন-রামাধীন এঁদের বোলিংয়ের বিরুদ্ধে, এসেছিলেন ১৩৮/২-তে, গেছিলেন ৫০৫/১০ – ওয়েস হল-এর অতিদ্রুত গতির শর্ট-বলগুলোকে হুক-পুল আর অন্যান্য বলগুলোকে ড্রাইভ মেরে তিনি তাঁর অধিকাংশ রান তুলেছিলেন। ঐ অনন্যসাধারণ সিরিজে পাঁচ ম্যাচে তিনি মোট ৫২২ রান করেন (গড় ৫২.২০), একটা শতরান ও তিনটে অর্ধশতরান সমেত। এই সময়ে তাঁকে পৃথিবীর চার দেশের চার সেরা ব্যাটারের মধ্যে একজন ধরা হ’ত – বাকি তিনজন ছিলেন গ্যারি সোবার্স, পিটার মে, ও হানিফ মহম্মদ।
১৯৬১ সালে গ্রীষ্মকালে ইংল্যান্ড সফরে তিনি ছিলেন দলের ব্যাটিংয়ের এক তরুণ-তারকা। জীবনের প্রথম ইংল্যান্ড সফরে সেদেশের আবহাওয়া-উইকেটের সঙ্গে তিনি চটপট মানিয়ে নেন এবং প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচে ছ’টা শতরান করেন। অ্যাশেজ-সিরিজে এজবাস্টনে শুরুটা (৮২) ভাল করলেও লর্ডস ও হেডিংলি-তে সুবিধে হ’লনা। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে প্রথম ইনিংসে জ্যাক ফ্ল্যাভেল ও ফ্রেডি ট্রুম্যান এই দু’জনের পেস বোলিংয়ে নাকাল হন, কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে দলের পক্ষে প্রয়োজনীয় ৬৭ রান করে আত্মবিশ্বাস ফিরে পান। ওভালে ট্রুম্যান-এর আউটস্যুইংয়ে প্রথমদিকে ঝামেলায় পড়লেও পরে সামলে নিয়ে চমৎকার শতরান (১১৭) করেন। টেস্টে ৩২৪ রান (গড় ৪০.৫০) সমেত সফরে ৬০-ছোঁয়া গড়ে প্রায় দু’হাজার রান ক’রে ১৯৬২-র Wisden (Five) Cricketer নির্বাচিত হন।
ইতিমধ্যে বিপক্ষীয় বোালাররা তাঁর bottom-handed ব্যাটিংয়ের খেলার technique বুঝে নিয়ে সেইমত আক্রমণ শানাতে শুরু করেছেন। ১৯৬২-৬৩ মরশুমে ফিরতি অ্যাশেজ-সিরিজে দেশের মাঠে তিনি নেহাৎ মন্দ খেলেননি – পাঁচ ম্যাচে ৩১০ রান, গড় ৩৪.৪৪, একটা শতরান ও দু’টো অর্ধশতরান সমেত। তবে এই সিরিজেই তাঁর টেস্ট গড় প্রথমবার ৫০-এর নিচে নামে, ২৬তম ম্যাচের পর। এরপর ১৯৬৩-৬৪ মরশুমে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে দেশের মাঠে টেস্ট-সিরিজেও তাঁর প্রদর্শন ভদ্রগোছেরই ছিল, চার ম্যাচে (চোটের জন্য একটা ম্যাচ খেলেননি) ২৮৫ রান, গড় ৪০.৭১, তিনটে অর্ধশতরান সমেত। কিন্তু্ বড় সমস্যা শুরু হয় তাঁর শারীরিক সুস্থতা নিয়ে, হাঁটুর চোট নিয়ে তিনি বেশ ভুগতে শুরু করেন। ১৯৬৪ সালের গ্রীষ্মকালে ইংল্যান্ড সফরে অ্যাশেজ-সিরিজে চার ম্যাচে করেন মাত্র ১৫৬ রান, গড় ৩১.২০, সর্বোচ্চ ৪৭ – ভারতে তিন-টেস্টের সিরিজের দু’টো ম্যাচে একাদশে থাকলেও বম্বের দ্বিতীয় টেস্টে অসুস্থতার কারণে কোনও ইনিংসেই ব্যাট করতে পারেননি – দল ম্যাচটা হারে, মাদ্রাজের প্রথম টেস্টে করেন ৪০ ও ০ – দল অবশ্য ম্যাচটা জেতে।
দলে তাঁর জায়গা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা শুরু হয়। তবে ১৯৬৫-র ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে জায়গা পান, সফরের অন্যান্য খেলায় তিনটে শতরান করলেও টেস্টে ব্যাটে তেমন রান ছিলনা, চার্লি গ্রিফিথ-এর বাউন্সারগুলো তাঁকে খুবই ঝামেলায় ফেলছিল। একটা সময় পরপর ১৫টা টেস্ট-ইনিংসে – ফেব্রুয়ারি-১৯৬৪-তে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সিডনি থেকে আরম্ভ করে এপ্রিল-১৯৬৫-তে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে গায়ানা – এমনকি একটা অর্ধশতরানও পাননি। শেষে বার্বাডোজের চতর্থ টেস্টে ৫১ ও ৭৪* এই দুই ইনিংস খেলে চার টেস্টে ২৬৬ (গড় ৪৪.৩৩) নিয়ে সিরিজ শেষ করেন। শেষটা তাঁর সুখের হয়নি। হাঁটুর অসুস্থতা, পড়তি ব্যাটিং-ফর্ম এই দুইয়ের সঙ্গে যোগ হয় এক বড় বিতর্ক। এরপর তিনি আর টেস্ট খেলেননি, তখন তাঁর বয়স সবে ২৮ পেরিয়েছে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর শেষ হওয়ার আগেই চার্লি গ্রিফিথের বোলিং-ভঙ্গি নিয়ে তিনি কড়া সমালোচনা করেন: “(O’Neill) agreed to put his name to a series of feature articles in Sydney’s Daily Mirror, which labelled Griffith as ‘an obvious chucker’ and said the hosts had been ‘wrong to play’ him. He further added that if he (Griffith) is allowed to continue throwing, he could kill someone.” এই বাবদে তিনি ইংল্যান্ডের তিন বিখ্যাত ব্যাটার কেন ব্যারিংটন, টেড ডেক্সটার ও জন এডরিচ এঁদের সঙ্গেই গলা মেলান। তিনি এমনও বলেন যে গ্রিফিথ-এর বিরুদ্ধে আবার খেলবার কোনও বাসনাই তাঁর নেই।
এর ফলে ‘সফরকালীন চুক্তিভঙ্গের দায়ে’ তিনি অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট প্রশাসকদের বিষনজরে পড়েন। সম্ভবত এই কারণে জাতীয় দলে তাঁর আর জায়গা হয়নি। তাছাড়া তাঁর তৎকালীন ব্যাটিং-ফর্ম ও হাঁটুর চোট এইসব মিলিয়ে ১৯৬৫-৬৬ মরশুমে দেশের মাটিতে অ্যাশেজ-সিরিজে বা ১৯৬৬-৬৭ মরশুমে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে তাঁর জায়গা হয়নি। ঐ মরশুমের শেষেই তিনি প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট থেকে অবসর নেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩০ বছর।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ও’নীল কিন্তু ক্রেগ-এর মতন ব্যর্থতার শিকার হননি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তাঁর খেলার ঔজ্জ্বল্য তিনি ধরে রাখতে পারেননি। তবুও মাত্র সাড়ে-ছ’বছরের টেস্ট-জীবনে ৪২ ম্যাচে মোট ২,৭৭৯ রান (গড় ৪৫.৫৫), ছ’টা শতরান ও ১৫টা অর্ধশতরান, সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে খুবই উল্লেখযোগ্য, বিশেষ করে যখন দেশে (১,৩৯৯ @৪৫.১২) ও বিদেশে (১,৩৮০ @৪৬.০০) তাঁর রান ও গড় প্রায় সমান-সমান – দেশে দুটো ও বিদেশে চারটে শতরান। প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে ১২ বছরে ১৮৮ ম্যাচে তাঁর সংগ্রহ ১৩,৮৫৯ রান (গড় ৫০.৯৫), ৪৫টা শতরান ও ৬৪টা অর্ধশতরান।
এসব সত্ত্বেও তাঁর প্রতিভার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেনি, ‘দ্বিতীয় ব্র্যাডম্যান’ নামের প্রত্যাশার চাপ অবশ্যই তার একটা বড় কারণ। তবে সেটাই বোধহয় সব নয়। মানসিকতার কিছু সমস্যাও হয়ত তাঁর ছিল। ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনী “Ins and Outs” বইতে তিনি লেখেন: “Batting is a lonely business. … (I) sometimes found First-Class cricket to be depressing and lonely.” ব্যাট করতে নামবার আগে প্রায়শই তিনি ভয়ানক স্নায়ুচাপে থাকতেন, বসে বসে ঘামতেন ও অনেক সময় পরপর সিগারেট টানতেন। ভাবলে অবাক লাগে যে এমন মানুষ কেমন করে তাঁর আকর্ষণীয় ব্যাটিং দিয়ে দর্শকদের মাতিয়ে রাখতে পারতেন।
১৯৬১-র ইংল্যান্ড সফরে তাঁর ব্যাটিং দেখে ওয়ালি হ্যামন্ড “branded him (O’Neill) the best all-round batsman he had seen since World War Two.” বিখ্যাত ক্রিকেট-সাংবাদিক জিম সোয়ান্টন লেখেন: “The art of batting, he reminded us, was not dead, merely inexplicably dormant.” তাঁর গুণমুগ্ধদের একজন, অ্যালান ডেভিডসন বলেছেন: “Once set, he (O’Neill) was the most exhilarating player you’d ever want to see — he was dynamite. He’d play attacking shots off balls other people would only think of defending. He had wonderful skill and technique. His shots off the back-foot down the ground off fast bowlers — you can’t really describe how good they were. … Yet he was the most humble, modest bloke you could ever run into.” তাঁর অনেকদিনের অধিনায়ক রিচি বেনো-র মতে: “(O’Neill was) one of the greatest entertainers we’ve had in Australian cricket.” তাঁর আরেক অধিনায়ক ববি সিম্পসন বলেছেন: “If God gave me an hour to watch someone I’d seen in my life, I’d request Norm O’Neill. He just had that style.” – ও’রিলি-ফিঙ্গলটন-পীবলস থেকে শঙ্করীপ্রসাদ হয়ে হ্যামন্ড-সোয়ান্টন ও ডেভিডসন-বেনো-সিম্পসন সবাই মুগ্ধ হয়েছেন যাঁর ব্যাটিং-শৈলীতে, তিনি ব্র্যাডম্যান-এর যোগ্য উত্তরসূরী না হলেই বা কি এসে যায়!
খানিকটা খেয়ালি-স্বভাবেরও ছিলেন হয়ত। তাঁর মায়ের যত্ন করে জমিয়ে-রাখা খবরের কাগজের হেডলাইনগুলো পুরনো বাক্সে পড়ে থাকত। তাঁর অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দলের পুরনো সোয়েটারের ওপর তাঁর প্রিয় পোষ্য কুকুর শুয়ে থাকত। তাঁর খেলোয়াড়-জীবনের স্মারক-স্মৃতিচিহ্নগুলো নিয়ে তিনি বিশেষ মাথা ঘামাতেন না বলেই জানা যায়। কেন এই উদাসীনতা কে জানে!
১৯৩৭ সালের ১২শে ফেব্রুয়ারি তারিখে জন্মগ্রহণ-করা নর্ম্যান ক্লিফোর্ড ও’নীল গলার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০০৮ সালের ৩রা মার্চ চিরকালের মতন চলে গেছেন।
[কৃতজ্ঞতা-স্বীকার: শঙ্করীপ্রসাদ বসু, অভিষেক মুখার্জি, অরুণাভ সেনগুপ্ত এবং Wisden ও ESPN CricInfo]