ট্রফি জিততে হলে পন্ডিতকে কোচ করার দরকার -প্রণব নন্দী

আঠারো বছর ধরে লাল-হলুদ ব্রিগেডের কোচ ছিলেন ময়দানের অভিজ্ঞ কোচ প্রণব নন্দী। কিন্তু এই বছর হঠাৎ পরিবর্তন। লাল-হলুদ ছেড়ে এইবার সবুজ-মেরুন অর্থাৎ মোহনবাগান দলে যোগ দিতে চলেছেন ময়দানের টুলটুল স্যার। ময়দান ও বাংলা ক্রিকেটের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে টালা পার্কের পাইকপাড়া স্পোর্টিং ক্লাবে বসে প্রায় আধ ঘন্টা অনর্গল উত্তর দিয়ে গেলেন বিভিন্ন প্রশ্নের।

প্রশ্ন:- আজ এতো বছর ইস্টবেঙ্গলের কোচ থাকার পরে এই বছর আপনি মোহনবাগানে। কোনো বিশেষ কারণ আছে এর?

প্রণব:- এই বছর মোহনবাগানে গিয়েছি তার বিশেষ কারণ নেই তবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই বছর ইস্টবেঙ্গল মোটামুটি ভালো খেলেছে। কিন্তু এই বছর যখন খেলোয়াড়রা জানতে চায় পরের বছরের কি ভবিষ্যৎ? কী টিম হচ্ছে? কে কোচ হচ্ছে? সেটা আমি বারবার ক্লাবকে জানাই যে খেলোয়াড়রা তো সিকিউরিটি চায়। যদি এই ক্লাব না খেলায় তবে অন্য ক্লাবে যাবে। তাই হ্যাঁ বা না যাই হোক অ্যাকশন তাড়াতাড়ি নিতে হবে। সেটা বলার পর প্রায় একমাস অতিক্রান্ত হয়, কোন  সদুত্তর পাইনি। এরপরে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব আমাকে প্রায় অন্ধকারে রেখে টিম তৈরী শুরু করে এবং তখন আমি ভাবি যে তাহলে ক্লাবের আমাকে কোচ রাখার দরকার নেই এবং তাই আমি নিজেকে তুলে নিই। ভেবেছিলাম অন্য ক্লাব ডাকলে যাবো নাহলে যেমন কোচিং ক্যাম্প করি তাই করবো। ইতিমধ্যে মোহনবাগান হয়তো তা জানতে পারে এবং আমাকে যোগাযোগ করে। আমি ইস্টবেঙ্গল ছাড়িনি, ইস্টবেঙ্গল আমাকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করেছে। এখন একটা ক্লাবের এইটুকু স্বাধীনতা আছে যে তারা নতুন কোচ আনতে পারে। আমার সঙ্গে কোনো মনোমালিন্য হয়নি। আমার যেমন কাজ ছাড়ার অধিকার আছে, তেমনই ক্লাবেরও অধিকার আছে নতুন কোচ আনার। এই বছর মোহনবাগান সবাইকে চুক্তিপত্রে সই করায় এবং সবাইকে বেশ সিকিউরিটি দেয়, সঙ্গে আমিও নিরাপত্তা পাই। এই অর্গানাইসড ব্যাপারটা আমার ভালো লাগে। আমি ২০০১ সালে কোচিং করানোর নেশায় যখন ভি. আর. এস নিয়ে নি তখন ইস্টবেঙ্গল ক্লাব আমাকে প্রথম সুযোগ দেয় এবং তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।

প্রশ্ন:- প্রায় আঠেরো বছর যুক্ত থাকার পরে যখন ক্লাব আপনাকে প্রায় অন্ধকারে রেখে টিম করলো। আপনার খারাপ লাগেনি?

প্রণব:- খারাপ লাগেনা, এখন এগুলো আর মনে দাগ কাটেনা। তবে ইস্টবেঙ্গলের কোচ যখন ছিলাম না তখনও ক্লাবের প্রয়োজনে গিয়েছি। তাই আজ তারা আমাকে বাদ দিলে তাতে আমি খুব অসম্মানিত হলাম এমন নয়। এই বদলগুলো খেলোয়াড়ের জীবনের অঙ্গ। কেউ সবসময় একই ক্লাবে থাকে না, কিন্তু আমি যেখানে থাকি সেইখানে নিজের মতামত দিয়েই কাজ করি। টিম যখন আমায় চালাতে হবে তখন সেইখানে কী প্লেয়ার আসবে সেটা তো আমার আগে জানা দরকার। তাই খেলোয়াড় আসা ক্লাবই ঠিক করবে কিন্তু আমার মনে হয় কোচের সহযোগিতা দরকার। সেটাই যখন হয়না তখন আমার মূল্য থাকেনা। বর্তমান পৃথিবীতে দুঃখ নিয়ে চলা যাবে না।

প্রশ্ন:- নতুন মোহনবাগান দলে জুনিয়র-সিনিয়র ব্যালান্স কিভাবে রাখবেন বলে ভাবছেন?

প্রণব:- এটা এখনই বলা সম্ভব নয়। এমন অনেক খেলোয়াড় আছে যাদের ভালো করে চিনিনা, মৌখিকভাবে হাই-হ্যালো আছে শুধু। যতক্ষণ মরশুমের প্র্যাক্টিস শুরু না হবে এটা বুঝবোনা। টিম নিয়ে কিছুদিন কাজ করার পরেই বলতে পারবো।

প্রশ্ন:- ইস্টবেঙ্গল আগের বছর সাদা বলে দুটো প্রতিযোগিতা চ্যাম্পিয়ন। এক্স-ফ্যাক্টর কি ছিল?

প্রণব:- কিছুই না। একজন দুইজন ছাড়া ইয়ং খেলোয়াড় ছিল। ওইসময় আমরা অসাধারণ খেলেছি। আমাদের খেলোয়াড়রা মূল কৃতিত্বের অধিকারী, আমার সঙ্গী কাঞ্চন মাইতির কথাও বলতে হবে। অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে খেলোয়াড়রা এবং এই জন্য আমরা দুটো ফরম্যাটে জিতি।

প্রশ্ন:- রণজ্যোৎ খাইরা, সুদীপ কুমার ঘরামী আজ আউটস্টান্ডিং খেলেছেন। এদের অবদান নিয়ে কি বলবেন?

প্রণব:- দেখো খেলোয়াড় ছাড়া কোনো টিম চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনা, কোচের ক্ষমতা কতটুকু? কোচ শুধু দিশা দেখাতে পারে খেলোয়াড়কে। কিন্তু প্লেয়ার নিজগুনে প্লেয়ার। সম্মিলিত প্রয়াস নিয়েই আমরা একটা শর্টস্প্যানে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি।

প্রশ্ন:- জে. সি মুখার্জী ট্রফির ফাইনালে ম্যাচ যখন ৯ ওভারের হয়ে যায় তখন তপন মেমোরিয়ালের বিরুদ্ধে কি স্ট্রাটেজি ছিল আপনাদের?

প্রণব:- সিএবি একসময় ভেবেছিল যে টাইম যদি বাড়ানো যায় এবং ওভারটা বাড়ানো যায়, কিন্তু তপন রাজি হয়নি। ৯ ওভারের খেলা এমন যে কোনো প্ল্যানিং হয়না, একটা ওভার ম্যাচ বদলে দিতে পারে। ওরা সেই ঝুঁকি নেয়, আমি বলেছি যা দেবেন তাই খেলবো। কারণ টস হওয়ার থেকে খেলা হওয়া ভালো।

প্রশ্ন:- ইস্টবেঙ্গল টিমে এই বছর রনজি ট্রফি খেলা খেলোয়াড় কম ছিল। তাও এই ফাইটিং স্পিরিট! কিভাবে সম্ভব হলো?

প্রণব:- বড়ো খেলোয়াড় বা ছোট খেলোয়াড় কিন্তু মাঠেই প্রমাণিত হয়। খেলোয়াড়দের মধ্যে বিশ্বাস জাগানোই আসল যে তোমরা ভালো, তোমরাও জিততে পারবে। আমি শুধু সাহসটা জুগিয়েছি যে তোমরা জিততে পারো।

প্রশ্ন:- আপনি অনুর্ধ-১৯ দলে যখন কোচ ছিলেন তখন দল দুর্দান্ত সফল। এই ব্যাপারে বলা হয় যে অনেকটা কৃতিত্ব আপনার।

প্রণব:- সেটা সর্বক্ষেত্রে ঠিক হয়তো নয়। কোচকে যেমন দোষ ম্যাচ হারলে দেওয়া হয় তেমনই জিতলেও যে কৃতিত্ব তার পাওয়া উচিৎ ততটাই। টিম যেমন পারফরমেন্স করবে তাতেই তো সাফল্য। ছয় বছর সিএবির কোচ ছিলাম, কোভিডের জন্য একবছর খেলা হয়নি। আমি চারবার নকআউট খেলি। অনুর্ধ-১৯ দলে প্রতিবছর বদল আসে, নতুন ছেলে আসে। নতুন ছেলে নিয়ে একবার চ্যাম্পিয়ন, একবার সেমিফাইনাল যাওয়াকে সাফল্য বলা যেতে পারে বলেই মনে হয়। খেলোয়াড় এবং অফিসিয়ালরা সাহায্য না করলে আমি পারতাম না। বলতে পারো সেক্ষেত্রে আমি ভাগ্যবান।

প্রশ্ন:- আজ যদি সিএবি সিনিয়র দলে কোচ হওয়ার জন্য বলে তবে ভাববেন?

প্রণব:- এটা তো আমার পেশা। বাংলা কোনো ব্যাপারে ডাকলে এটা সম্মানের প্রশ্ন। অর্থও জড়িত আছে যেমন, সন্মানও আছে তাই ডাকলে আমার দ্বিরুক্তি থাকবেনা। মোহনবাগানের সঙ্গে আমার সেইরকম চুক্তিই আছে যে কোনো রাজ্যদল ডাকলে আমি যেতে পারি।

প্রশ্ন:- বাংলা আগের বছর ফাইনাল খেললো এবং এই বছর সেমিফাইনাল।

প্রণব:- খুব ভালো পারফরমেন্স আমি বলবো অরুণলালের অধীনে। উনি কেন ছেড়ে দিলেন জানিনা তবে ওনাকে আমি খুবই সফল বলবো।

প্রশ্ন:- আর কি করলে চ্যাম্পিয়ন হতে পারতো?

প্রণব:- এটা আমি বলতে পারবোনা কারণ ভেতরের ব্যাপার জানিনা. তবে শেষ দশ-বারো বছরে বাংলা খুব ভালো টিম। বোলিং দুর্দান্ত, সঙ্গে ব্যাটিং দেখো। অনুষ্টুপ দারুন খেলেছে, অন্যরাও ভালো। বেশ কিছু লাক ফ্যাক্টর থাকে যে ওইদিন কিরকম খেলছো, টিম সিলেকশন কেমন হচ্ছে এইসব। ভুল হয়ে যায় অনেকসময়। তবে বাংলা শেষ দুই বছর অত্যন্ত ভালো খেলেছে। রনজি জেতা কিন্তু সহজ নয়। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে চন্দ্রকান্ত পন্ডিত কিন্তু অসাধারণ। যদি পারফরমেন্স দেখো তবে কিন্তু আমি বুঝিনা কেন পন্ডিত ভারতের কোচ হয়না। রনজি ট্রফি খেলে কেউ টেস্ট টিমে চান্স পায় তবে কোচ কেন নয়? ছয়বার জিতেছে, আর সে কী করতে পারে? তোমরা হাইলাইট করো না এগুলো।

প্রশ্ন:- কোচ হওয়ার কোয়ালিফিকেশন কি ভালো আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেটার হওয়া?

প্রণব:- এটা তো হওয়া ঠিক নয়।

প্রশ্ন:- এটাই তো হয়ে আসছে।

প্রণব:- সেটা তো ভাবনার জন্য হয়ে আসছে। ভালো খেললে ভালো কোচ হওয়া যায়না এটা পরিক্ষিত সত্য। তাহলে মারাদোনা, পেলে ভালো কোচ হতে পারতেন। আবার অনেকে আছে যাঁরা সর্বস্তরে ভালো করেছেন যেমন বেকেনবাওয়ার। তবে পারফরমেন্সই শেষ কথা হওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি। সেইখানে এই মুহূর্তে ভারতবর্ষে চন্দ্রকান্ত পন্ডিতকে সবচেয়ে সফল বলে আমি মনে করি এবং বাংলার ট্রফি জিততে হলে ওনাকে কোচ করে আনা প্রয়োজন।

প্রশ্ন:- ময়দানে তো বলা হচ্ছে লক্ষী রতন শুক্লাও অনেক বদল আনতে পারেন।

প্রণব:- সেটা প্রমাণ করতে হবে আর পন্ডিত প্রমাণ করে দিয়েছেন। আমি বলছিনা লক্ষী রতন খারাপ কোচ, উনিও জেতাতে পারেন। একটা কথা আছে টু প্রুভ আর আরেকটা গ্যারান্টিড। আমি তুলনা করছিনা। লক্ষীরতন দশবারে পাঁচবার রনজি জিতে গেলে কিন্তু ওকে সেরা মেনে নিতেই হবে। তবে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে পন্ডিত সবচেয়ে সফল। এই বিষয়ে সন্দেহ আছে?

প্রশ্ন:- একদমই নয়।

প্রণব:- সেটাই বললাম।