ইডেন গার্ডেন্সে বাংলা ও কর্ণাটকের মধ্যে চলছে রনজি ট্রফির সেমিফাইনাল ম্যাচ। প্রথমেই অভিষেক কুমার রমন এবং তার কিছু পরে অভিমন্যু ঈশ্বরণকে হারিয়ে রীতিমতো বিপাকে বাংলা। তিন নম্বরে ব্যাট করা সুদীপ চ্যাটার্জীর সঙ্গে চার নম্বরে সেদিন আসার কথা মনোজ তিওয়ারির। অন্তত ইডেনের তিন নম্বর গ্যালারিতে বসা কিছু বাংলা সমর্থক মনে করেছিলেন তাই। কিন্তু ব্যাট হাতে নামতে দেখা গেল হুগলীর চুঁচুড়ার বাবুগঞ্জ এলাকার অর্ণব নন্দীকে। ব্যাটিং অর্ডারে এইরকম পরিবর্তন একটাই জিনিস বোঝায়। নতুন বলে ভয়ঙ্কর রণিত মোর-প্রষিদ্ধ কৃষ্ণর সামনে সামনের সারির ব্যাটারদের রক্ষা করাই একমাত্র উদ্দেশ্য তখন বঙ্গ ম্যানেজমেন্টের। সেই জায়গায় আসা ব্যাটার যদি কিছু রান করে দেন তবে তা বোনাস, আসল লক্ষ্য ভয়ঙ্কর সময় পেরিয়ে যাওয়া। তবে সেদিন ব্যাট করতে আসা অর্ণব শুধু ভয়ঙ্কর সময় পারই করেননি বরং ১৪ ওভার ক্রিজে থেকে ৪১ বল ব্যাট করে ১৭টি রান করে যান। এমনকি কভার অঞ্চল দিয়ে প্রসিদ্ধ কৃষ্ণকে মারা ড্রাইভকে ‘গ্লোরিয়াস’ আখ্যা দেওয়া যায় নিঃসন্দেহে।
আবার জায়গা সেই ইডেন গার্ডেন্স। এবার মঞ্চটা ডিস্ট্রিক্ট ফাইনালের। সম্পূর্ণ বাংলা ক্রিকেট বর্তমানে নদীয়া জেলার ব্যাটার অয়ন গুপ্তকে জানে একজন অসাধারণ ওয়ান ডে খেলোয়াড় বলে। সেই মতো হুগলী জেলার দেওয়া ২৫৪ রানের লক্ষ্য তাড়া করছে নদীয়া। একসময় শেষ বারো ওভারে বাকি ৭৬ রান এবং একজন সেট টপ অর্ডার ব্যাটার থাকলে তা রীতিমতো তাড়া করা সম্ভব এই অবস্থায় বল নিজের হাতে তুলে নিলেন হুগলী রিভার্স অধিনায়ক। ওভারের পঞ্চম বল অফস্ট্যাম্পের একটু বাইরে ফেললেন এবং লাইন বুঝতে অয়ন সামান্য ভুল করতেই তা নিচু হয়ে নড়িয়ে দিল অফস্ট্যাম্প। অয়ন ৬০ বলে ৫১ করে ফিরতেই মাত্র চার ওভারের মধ্যে শেষ হয়ে গেল নদীয়া। উল্লেখ্য তার মাত্র কিছু ঘন্টা আগে এক অধিনায়কচিত হাফসেঞ্চুরি করে দলকে আড়াইশো রানের গন্ডি টপকে দিয়েছেন অর্ণব।
এই বছর মোহনবাগান দলের হয়ে লিগ স্তরে সাত নম্বরে ব্যাট করে ৬ ইনিংসে ৮২.৯৯ স্ট্রাইক রেট এবং ৪৭.৮০ গড়ে ২৩৯ রান তুলেছেন অর্ণব নন্দী। এছাড়াও ৭টি উইকেটও পেয়েছেন। ভবানীপুর ক্লাবের বিরুদ্ধে ভিডিওকন মাঠে যখন অরিন্দম ঘোষ আউট হয়ে ফিরে যাচ্ছেন তখন ব্যাট করতে এসে ইনিংসের শুরুতেই বলকেশ যাদবকে একটি স্লগ সুইপে স্কোয়ার লেগ দিয়ে চার মারেন অর্ণব। এছাড়া রবিকান্ত সিংকে লেগ সাইডে জায়গা করে নিয়ে সরাসরি তুলে দেন লং অনের ওপর দিয়ে এবং সেটি হয় একটি বিশাল ছক্কা। সেইদিন মাঠে বসে আছি আব্দুল মোনায়েমের পাশে এবং ভবানীপুর কোচ তখন বললেন বাটুর(অর্ণব নন্দী) এই শটগুলোয় দক্ষতা থাকার কথা। পাশাপাশি তিনি এটিও বলেন যে প্যাটসি অর্থাৎ সৌরাশিষ লাহিড়ীর যোগ্য রিপ্লেসমেন্ট হয়তো হতে পারতেন অর্ণবই। কারণ সাদা বলের ক্রিকেটে যে মুন্সীয়ানা তিনি দেখিয়েছেন তাতে তাঁকে ফেলে দেওয়া কখনোই যায়না। ঐদিন ১৩১ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলে ৫৪৫ রানের গন্ডি টপকে দেন মোহনবাগানকে। এছাড়া এই বছর ফার্স্ট ডিভিশন ওয়ান ডে টুর্নামেন্টে মাত্র ৪ ইকোনমিতে বল করে ৬টি উইকেট নেন অর্ণব যা মিডল ওভারে যে কোনো স্পিনারের পক্ষে সবসময় ভালো।
টিটোয়েন্টি ক্রিকেটে এই বছর একার হাতে ম্যাচ জেতানোর রেকর্ডও করেছেন অর্ণব। বাইজুস্ টিটোয়েন্টিতে খড়গপুর ব্লাস্টার্স দলের বিরুদ্ধে কৃষ্ণনগর চ্যালেঞ্জার্স দলের হয়ে চার নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ৩৮ বলে ৫৯ রানের একটি ইনিংস খেলেন যা শেষ দশ ওভারে তার দলকে ১০০ রান করতে সাহায্য করে এবং পরে বল হাতে ৪ ওভারে ১২ রান দিয়ে ৩ উইকেট তুলে নেন তিনি। ফলে একাধিক তারকা ক্রিকেটার থাকলেও খড়গপুর ম্যাচ হারে ৫২ রানে।
কিছুদিন আগে মা মারা গিয়েছেন অর্ণব নন্দীর। তার পরেই ছিল মোহনবাগান বনাম ভবানীপুর লিগ সেমিফাইনাল। হোয়াটস্যাপ করে জিজ্ঞেস করি তিনি খেলবেন কিনা? সেদিন উত্তরে বলেছিলেন “বাবা বলেছিলেন কমিটমেন্ট ভাঙবে না। বাবা মারা যাওয়ার পরে রক্স টিটোয়েন্টি খেলি। কাল ও খেলবো ম্যাচ।” ঠিক এই কমিটমেন্ট না ভেঙেই আজ ময়দানের একজন কিংবদন্তীর পর্যায়ে পৌঁছেছেন অর্ণব। একসময় খেলতেন উৎপল চ্যাটার্জীর সঙ্গে, সেখান থেকে আজ তার সতীর্থ সুমিত মোহান্ত, সোনু নৌবাগরা। অর্ণব নন্দীরা এমনই। তাদের জন্য জায়গা না থাকলেও, দরজা বন্ধ হয়ে গেলেও তারা খেলে যান। শুধু খেলার আনন্দেই।