অগ্নিময় অভিষেক
টেস্ট-ম্যাচ দিয়েই তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় এবং সেই অভিষেক-ইনিংসে তিনি মা্ত্র দুটো বল খেলে কোনও রান না করেই আউট হয়ে যান, আর তাঁর ওডিআই অভিষেক-ম্যাচে ব্যাট করবার সুযোগই পাননি। অল্প কিছুদিন পরে, ঐতিহ্যমন্ডিত অ্যাশেজ সিরিজে ২০১৯ সালে প্রথম অবতরণের সময়ই তাঁর নামটা “Guinness Book of World Records”-এ উঠে যায়, একটা বলও খেলবার বা একটা রানও করবার আগেই।
আজ্ঞে হ্যাঁ, মার্নাস লাবুশেন নামক এই অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারটির টেস্ট-ক্রিকেটে উত্থান এমনই আশ্চর্যভাবে। ২০১৯ সালের ১৮ই অগাস্ট লর্ডসের দ্বিতীয় টেস্টের পঞ্চম দিনে “M Labuschagne replaced SPD Smith as a concussion substitute during Australia’s 2nd innings.” কারণ? ঠিক আগের দিন অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসে দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাটার স্টিভ স্মিথ ব্যক্তিগত ৮০ রানের মাথায় ইংল্যান্ডের পেসার জোফ্রা আর্চার-এর এক বাউন্সারে মাথায় চোট পেয়ে সাময়িক অবসর নেন। যদিও স্মিথ খানিকক্ষণ পরে আবার ব্যাট করতে নামেন ও ৯২ রান ক’রে আউট হন, সেদিন খেলার শেষে তাঁর শারীরিক অসুবিধের কারণে, ICC-র নতুন নিয়ম অনুযায়ী, টেস্ট-ইতিহাসের প্রথম ‘পরিবর্ত ব্যাটার’ হয়ে পরের দিন অজিদের দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে আসেন এই লাবুশেন। চাপের মুখে ১৯-২ থেকে ১৩২-৪, ৩০.৩ ওভার উইকেটে থেকে ১৩৫ মিনিটে ১০০ বলে ৫৯ রান (৪x৮) ক’রে মার্নাস তাঁর যোগ্যতার পরিচয় দেন।
সেই টেস্ট-সিরিজেই পরপর চার ইনিংসে চারটে অর্ধশতরান সমেত চার ম্যাচে (পঞ্চাশেরও বেশি ব্যাটিং গড়ে) মোট সাড়ে-তিনশোরও বেশি রান করে বুঝিয়ে দেন যে কেবলমাত্র ‘concussion substitute’ হয়ে থাকতে টেস্ট-ক্রিকেটে তিনি আসেননি। দশটা টেস্ট খেলবার পর থেকেই তাঁর ব্যাটিং গড় ঘোরাঘুরি করেছে ৫৩.৫২ থেকে ৬৩.৪৩ এর মধ্যে – করে ফেলেছেন ২৬টা ম্যাচে ৪৫টা ইনিংসে ৬টা শতরান ও ১৩টা অর্ধশতরান সমেত মোট ২,৩৯০ রান।
সেই অগাস্ট থেকে ২০১৯ সাল শেষ হওয়া পর্যন্ত তাঁর টেস্ট-ইনিংসগুলো দাঁড়িয়েছিল এইরকম: ৫৯, ৭৪, ৮০, ৬৭, ১১, ৪৮, ১৪, ১৮৫, ১৬২, ১৪৩, ৫০, ৬৩, ১৯ – এক বছরে ১১ ম্যাচে ১,১০৪ রান, গড় ৬৪.৯৪, তিনটে শতরান ও সাতটা অর্ধশতরান সমেত। ২০২০-র জানুয়ারিতে আবার করেছিলেন ২১৫ ও ৫৯ – অনেক আগেই টেস্ট-দলের নিয়মিত ওয়ান-ডাউন ব্যাটার হয়ে গেছেন। ক্রিকেট-দুনিয়া নড়েচড়ে বসল তাঁর এই মাস-ছয়েকের কান্ডকারখানা দেখে। ব্যাপারটা কি!
উত্থানের নেপথ্যে
২০১৮ সালের মার্চ মাসে দুবাইতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিষেক-হওয়া লেগ-স্পিন-করানো ব্যাটার-অলরাউন্ডার মার্নাসের প্রথম পাঁচ টেস্টের রানের খতিয়ান: বিদেশে – ০ ও ১৩, ২৫ ও ৪৩ [বনাম পাকিস্তান], দেশে – ৩৮ [বনাম ভারত], ৮১, ৬ ও ৪ [বনাম শ্রীলঙ্কা] – আট ইনিংসে ২১০ রান, নেহাৎ জঘন্য না হলেও আহামরি কিছুই নয়। বরং বোলিংয়ে ঐ পাঁচ ম্যাচে ৬০ ওভারে ২৪৪ রান দিয়ে ন’টা উইকেট বোধহয় তুলনায় কিঞ্চিৎ বেশি উৎসাহব্যঞ্জক ছিল। কিন্তু ভবিষ্যতের গর্ভে ছিল ২০১৯-এর ব্যাট হাতে তাঁর চমক।
আসুন, একবার বোঝবার চেষ্টা করি কেমনভাবে এক বছরেরও কম সময়ে মার্নাস এতোটা উন্নতি করলেন। এর বড় ভিত্তি ছিল ২০১৯ সালের ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেট-মরশুমে গ্ল্যামোরগান কাউন্টি দলে তাঁর যোগদান। আর এর সঙ্গে ছিল একটা subtle technical পরিবর্তন। সেটা কি?
গ্ল্যামোরগান দলের কোচ (ইংল্যান্ডের আশি-নব্বই দশকের প্রাক্তন টেস্ট-ওডিআই খেলোয়াড়) ম্যাথু মেনার্ড-এর কথাতেই বর্ণনা করা যাক: “For me, his bat path wasn’t great. It wasn’t coming down on the line of the ball, it was coming from a little wider. The reason for that was (the position of) his hip and his back leg. So, we addressed that balance to keep his hips a little more side-on and therefore keeping that back-foot parallel to the crease. All of a sudden, that righted the bat path to the ball.” ব্যস, নিয়মিত কড়া প্র্যাকটিসের সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা-বিশ্লেষণে ক্লান্তিহীন মার্নাস পেয়ে গেলেন এক তুখোড় ক্রিকেটীয় পরামর্শ।
ফলও পাওয়া গেল হাতেনাতেই। গ্ল্যামোরগানে আসার আগে, (২০১৪ সালে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেকের সময় থেকে) ৫০টা প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচের ৯৩ ইনিংসে তিনি করেছিলেন ২,৮১২ রান, গড় ৩১.৯৫, চারটে শতক ও ১৭টা অর্ধশতক সমেত। তাঁর এই ‘bat path’ ও ‘foot alignment’ পাল্টাবার পর ৩৩ ইনিংসে ৬০.৫২ গড় নিয়ে তিনি করেন ১,৭৫৫ রান, পাঁচটা শতক ও ১২টা অর্ধশতক সমেত।
মেনার্ডের মতে, মার্নাসের আগেকার technique অস্ট্রেলিয়াতে তাও চলতে পারতো কিন্তু ইংল্যান্ডে, যেখানে সাধারণত বোলাররা অনেক বেশি সরাসরি উইকেট তাক করে বোলিং করেন, সেখানে তিনি অনেক বেশি অরক্ষিত হয়ে যাবেন। তিনি বলেন: “It was something we wanted to address as soon as possible. … It wouldn’t have worked if he had a closed mind. Marnus was very keen to learn, he’s got a very open mind.” বিগত বছর-পাঁচেক ধরে “just a run of the mill grade cricketer” আর না হয়ে থাকবার জন্য যে লড়াই তিনি করছিলেন, মার্নাস তার জন্য এক কার্যকরী হাতিয়ার পেয়ে গেছিলেন।
কিন্তু কয়েকটা কঠিন সত্য মার্নাস অকপটে জানিয়েছেন: “There is a long, long process to this. It didn’t just happen overnight, and everything just magically clicked. … You must go through – the ups and downs of (Sheffield) Shield cricket to understand what it requires to keep coming back, and the highs and the lows to fully grasp how to become a better player. There will be many more of both but if you can understand that early, you are better placed to take the chances when they arrive.”
তিনি আরো বলেন যে ইংল্যান্ডে গিয়ে নেট প্র্যকটিসের থেকে ম্যাচ প্র্যাকটিস তিনি অনেক বেশি পেয়েছেন, যাতে তাঁর বিশাল সাহায্য হয়েছে। তাঁর কথায়: “The one thing I learned in England was to really cherish that time in the middle. … You can’t give that up for anything. That’s where I did a lot of the learning over the (Northern) summer.“
মার্নাসের উপমহাদেশীয় উইকেটে খেলবার অভিজ্ঞতা সীমিত এবং অজিদের সাম্প্রতিক পাকিস্তান সফরে স্পিনারদের দাপট ছিলনা বললেই চলে। তাই শ্রীলঙ্কা সফরের স্পিন-মোকাবিলার বড় চ্যালেঞ্জের জন্যও মার্নাস আরেক ইংরেজ ব্যাটারের অভিজ্ঞতা থেকে প্রস্তুতি নিতে চান। সেই ব্যাটারটি আর কেউ নন, সম্প্রতি-প্রাক্তন অধিনায়ক জো রুট, যিনি সেদেশে ২০২১ সালের প্রথমদিককার সফরে অসাধারণ ব্যাটিং করেছিলেন। দেখা যাক, কি হয়!
১৯৯৪ সালের ২২শে জুন তারিখে দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্মানো মার্নাস লাবুশেন ২৮ পেরিয়ে আজকে ২৯-এ পা রাখছেন। তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে আমার এই রচনা।
[ছবি: ইন্টারনেট থেকে]