“পনেরো পা”-এর পেস-বোলার

টেস্ট-ক্রিকেটে (তৎকালীন) প্রায় ৮৪ বছরের ইতিহাসে সর্বপ্রথম একই ম্যাচে একশোর ওপর রান (১২৪=৪৪+৮০) করা এবং দশটা-বা-তার-বেশি উইকেট (১১/২২২=৫/১৩৫+৬/৮৭) নেওয়া ক্রিকেটারটি বেঁচে থাকলে আজ (১৪ই জুন, ২০২২) তিনি ৯৩ পেরিয়ে ৯৪-এ পা রাখতেন।

ওয়াসিম আক্রমের দুরন্তপনার জমানার আগে ‘কাল্পনিক বিশ্ব একাদশ’-গুলোয় বাঁ-হাতি পেস বোলার প্রয়োজন হ’লে শতকরা আশির বেশি ক্ষেত্রে তাঁর জায়গা ছিল অবধারিত। গ্যারি সোবার্স-এর আত্মজীবনীতে তাঁর সম্বন্ধে লেখা ছিল: “perhaps the best new-ball bowler in the world for a period of about five years and a magnificent hitter.” রিচি বেনো-র কথায়: “The beauty of an almost perfect fast-medium action with a disconcerting late swing has caused untold worry to opening batsmen the world over.” এবং “’When you see that big right foot coming down the wicket, brother, you duck,’ is an accurate and revealing recommendation given by an Australian bowler one day when asked how he felt about the carving just administered by the burly New South Welshman.” টেড ডেক্সটারের বিশ্লেষণ অনুযায়ী: “Unlike the moderns who rush through the crease, he made a full turn, getting his front foot close to the stumps and then making a full body rotation. Swing and cut were a natural result. So, he had good control, which accounts for his excellent career stats.

এতক্ষণে আপনারা নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন যে আমি কার কথা লিখছি। হ্যাঁ, তিনি হলেন অ্যালান কিথ ডেভিডসন, ওরফে ‘Davo’ যাঁকে তাঁর ফিল্ডিং-দক্ষতার জন্য তাঁর সহ-খেলোয়াড়রা অনেকে ডাকতেন ‘Claw’ নামে যে নামটা তাঁকে দিয়েছিলেন কীথ মিলার।

সেই আমলে ‘ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়’ পুরস্কারের প্রচলন থাকলে ১৯৬০-৬১ মরশুমে ব্রিসবেনের ‘টাই টেস্ট’-এর পর ঐ পুরস্কারটা গ্যারি সোবার্স (প্রথম ইনিংসে ১৭৪ মিনিটে ১৩২ রান) বা নর্ম্যান ও’নীল (দু’ইনিংস মিলিয়ে ১৮১+২৬=২০৭ রান) কেউই পেতেন ব’লে মনে হয়না। সেটা নিশ্চয়ই যেত Davo-রই হাতে। কেন? এই রচনার একদম শুরুতেই তার স্পষ্ট আভাস দিয়েছি। শুধু সংখ্যার বিচারেই নয়, চতুর্থ ইনিংসে ২৩৩ রান তাড়া করতে নেমে ওয়েস হল-এর বলে খাবি-খাওয়া অজিদের ৫৭-৫ থেকে টেনে ২২৬-৭ অবধি টেনে জয়ের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া এবং হল-ওরেল-সোবার্স-ভ্যালেন্টাইন-রামাধীন বোলিং-আক্রমণের বিরুদ্ধে করা (রান আউট হয়ে শেষ হওয়া) ১৯৪ মিনিটে ৮০ রানের ইনিংসটা ম্যাচ পরিস্থিতির বিচারে অসাধারণ।

তাঁর টেস্ট-জীবনের প্রথম বারোটা ম্যাচে (১৯৫৩ থেকে ১৯৫৬-৫৭ এই সময়কালে পাঁচটা সিরিজে) তিনি বিশেষ উল্লেযোগ্য কিছুই করে উঠতে পারেননি – মাত্র ১৬টা উইকেট, শ’তিনেক রান ও ১৩টা ক্যাচ। এর একটা সম্ভাব্য কারণ হয়ত ছিল লিন্ডওয়াল-মিলার জুটি থাকায় নতুন বলে স্যুইং করানোর অত্যল্প সুযোগ পাওয়া।

তবে ১৯৫৭-৫৮ মরশুমে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে তাঁর বোলিং দাপট শুরু এবং এই সময় থেকে পরবর্তী ৩২টা ম্যাচ খেলে (১৯৬২-৬৩ মরশুম পর্যন্ত মোট সাতটা সিরিজে) ১৭০টা উইকেট নেন – একটা ম্যাচ খেলেননি চোট-আঘাতের জন্য। এর মধ্যে বিদেশে ১৮ ম্যাচে ৮৯টা [ইংল্যান্ডে পাঁচে ২৩, ভারতে পাঁচে ২৯, পাকিস্তানে তিনে ১২, দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঁচে ২৫] এবং দেশে ১৪ ম্যচে ৮১টা [ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দশে ৪৮ ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে চারে ৩৩] শিকার রয়েছে। এই পরিসংখ্যানের টুকরোটা সেইসব কতিপয় ‘কিঞ্চিৎ উন্নাসিক’ বিশেষজ্ঞদের জন্য যাঁরা ‘উনি তো উপমহাদেশে কখনও উইকেট পাননি’ এমন ব’লে মুখ বেঁকিয়ে থাকেন!

আজ আমি ডেভিডসনের ক্রিকেট-জীবনের নিছক পরিসংখ্যানগুলোই কেবল ‘টুকে’ দেবনা – (যথার্থভাবেই) কিছু ক্রিকেট-বিশেষজ্ঞের মতে সেগুলো তো ESPN CricInfo বা HowSTAT (নিদেনপক্ষে Wikipedia) এইসব ক্রিকেটীয় web-site-এ গেলেই পাওয়া যায়, আর Google Translate তো রয়েছেই আড়ষ্ট বঙ্গানুবাদ করবার জন্য, তাইনা! অতএব আজ বরং টেস্ট-ক্রিকেটে দেশ-বিদেশে ওঁর কয়েকটা ‘game-changing performances’ একটু ছুঁয়ে যাই, কেমন? সত্তর-পেরোনো আপনাদের কারো কারো হয়তো মনে পড়তেও পারে Davo-র কথা। 

১৯৫৭-৫৮ মরশুমে পোর্ট এলিজাবেথে ৪৬.১-১৪-৮২-৯ নেন, যার মধ্যে জ্যাকি ম্যাকগ্লু, রাসেল এন্ডিন, জনি ওয়েট ও কেন ফানস্টন এঁদেরকে দু’ইনিংসেই আউট করেন। ১৯৫৮-৫৯ মরশুমে মেলবোর্নে ৪০.৫-৯-১০৫-৯ – শিকারদের মধ্যে ছিলেন পিটার রিচার্ডসন, উইলি ওয়াটসন (দু’বার), টম গ্রেভনি ও কলিন কাউড্রে। ১৯৫৯-৬০ মরশুমে কানপুরে ৭৭.৪-৩০-১২৪-১২ – শিকারদের মধ্যে ছিলেন আব্বাস আলি বেগ, চান্দু বোরদে, রামনাথ কেনি (দু’বার) পঙ্কজ রায়, নরি কন্ট্র্যাক্টর ও পলি উমরিগর। ১৯৬২-৬৩ মরশুমে সিডনিতে ৩৫.৩-৯-৭৯-৯ – শিকারদের মধ্যে ছিলেন ডেভিড শেপার্ড (দু’বার), কেন ব্যারিংটন, ফ্রেড টিটমাস, জন মারে, জিওফ পুলার ও টেড ডেক্সটার। এই তালিকাটা দেখলে বুঝবেন যে ওপরের দিককার বা স্বীকৃত ব্যাটারদের উইকেট নেওয়ার ব্যাপারে তাঁর দক্ষতা – উল্লিখিত চারটে ম্যাচে ৩৯ বারের মধ্যে ২৭ বার, অর্থাৎ প্রায় ৭০ শতাংশ, বলা দরকার যে অস্ট্রেলিয়া কানপুর বাদে বাকি তিনটেতেই জেতে।

এবার উল্লেখ করি ১৯৬১ সালের ইংল্যান্ড সফরে দু’টো অ্যাশেজ টেস্টে তাঁর অবদান, লর্ডসে ও ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে – দু;ম্যাচেই অজিরা জেতে এবং সেই সিরিজের ফলাফল ছিল ২-১, তাদের পক্ষে। লর্ডসের দ্বিতীয় টেস্টে টসে জিতে ব্যাট করতে নেমে ইংল্যান্ড প্রথম দিনেই ২০৬ রানে খতম হয়, ডেভিডসন ২৪.৩-৬-৪২-৫, শিকার ছিলেন পুলার, পিটার মে, ব্যারিংটন, টনি লক ও ফ্রেডি ট্রুম্যান। উত্তরে অস্ট্রেলিয়া করে ৩৪০। দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যান্ডের ২০২, তবে নবাগত গ্রাহাম ম্যাকেঞ্জি (২৯-১৩-৩৭-৫) ছাপিয়ে যান Davo-কে (২৪-৮-৫০-২, শিকার ছিলেন রামন সুব্বা রাও ও ব্যারিংটন)। ব্রায়ান স্ট্যাথাম ও ট্রুম্যান-এর মরণ কামড় সামলে ১৯-৪ থেকে ৭১-৫ তুলে অজিরা জেতে, জয়ের মুহূর্তে মাঠে ছিলেন পিটার বার্জ (৩৭*) ও তাৎপর্যপূর্ণভাবে সাত-উইকেট-শিকারী ডেভিডসন (০*)। 

ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের চতুর্থ টেস্টে সিরিজ ১-১ অবস্থায় টসে জিতে ব্যাট ক’রে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসের মাত্র ১৯০ রানের জবাবে ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্যবান ৩৬৭ রানের [Davo নেন ৩৯-১১-৭০-৩, এবার শিকার ছিলেন পুলার, সুব্বা রাও ও মে] উত্তরে অজিরা তখন ২৯৬-৬, এমন সময়ে নামলেন (প্রথম ইনিংসে ‘গোল্লা’-করা) Davo এবং কেন ম্যাকে-র সঙ্গে ৩৬ রান যোগ করলেন। দল তখন সবে দেড়শোর থেকে সামান্য বেশি রানে এগিয়ে, এই অবস্থায় পরপর তিনটে উইকেট গেল, ৩৩৪-৯, নামলেন last man জীবনের তৃতীয় টেস্ট-খেলা ‘Garth’ ম্যাকেঞ্জি। শেষ উইকেটে Garth-কে সঙ্গে নিয়ে Davo যোগ করলেন মহামূল্যবান ৯৮ রান (১০২ মিনিটে), নিজে করলেন ১৭৪ মিনিটে ৭৭ রান (১০x৪, ২x৬), যে ইনিংস দলকে দিল ২৫৫ রানের লড়াইয়ের রসদ। আর চতুর্থ ইনিসে ১৫০-১ থেকে বেনোর দুরন্ত আক্রমণাত্মক বোলিংয়ে ২০১ রানে অল-আউট হয়ে ইংল্যান্ড ম্যাচ (ও সিরিজ দুইই) হারাল। আবার তাৎপর্যপূর্ণভাবে শেষ উইকেটটা (স্ট্যাথাম বোল্ড ডেভিডসন ৮) নিয়ে ম্যাচ শেষ করেন Davo (১৪.৪-১-৫০-২, আরেক শিকার ছিলেন পুলার, ৪০ রানের ওপেনিং জুটি ভাঙ্গতে)। তাঁর ঐ ইনিংসটা ছাড়া অজিদের যে কি অবস্থা হ’তে পারত, সে কথা অধিনায়ক বেনো তাঁর “A Tale of Two Tests” বইতে লিখেছেন। 

১৯৫৭-৫৮-তে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ থেকে শুরু ক’রে যে ৩২টা টেস্টে Davo খেলেছেন, তার মধ্যে অস্ট্রেলিয়া ১৬টা জিতেছিল ও চারটে হেরেছিল। তার আগের চার বছরে, ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৬-৫৭, তাঁর খেলা ১২টা টেস্টের মধ্যে অজিরা হেরেছিল সাতটা এবং একটাও জেতেনি। এটা কি নেহাতই কাকতালীয়? আরেকটু জানাই – তাঁর অবসর নেওয়ার পরবর্তী ৩০টা টেস্টে অজিরা জেতে ছ’টা ও হারে আটটা। আরো কাকতালীয়? আপনারাই ভাবুন!

রচনার শুরুতে সোবার্স, বেনো, ডেক্সটার এঁদের শরণ নিয়েছি। মধ্যপর্বে ESPn Cric Info-রও শরণ নিয়েছি! এবার শেষ করছি একটা উদ্ধৃতি দিয়ে: “Great players are either performers or entertainers. Davidson was both.” – বলেছিলেন ডন ব্র্যাডম্যান, Davo-র আত্মজীবনী “Fifteen Paces”-র গৌরচন্দ্রিকা (foreword) লিখতে গিয়ে। বাকিটা ক্রিকেট-ইতিহাসের পাতায়। 

[ছবি: লেখকের ব্যক্তিগত পুস্তক-সংগ্রহ থেকে]