আঁস্তাকুড় থেকে সিংহাসনে ঋদ্ধিমান

এই আইপিএল তাঁর কাছে প্রমাণ করার মঞ্চ ছিল। পঞ্চদশ সংস্করণ ঋদ্ধিমান সাহার জীবনের অভিশাপ হতেই পারত। মেগা অকশনের প্রথম পর্যায়ে যে ছেলেটা দল পায় না, যে ছেলেটাকে লজ্জায় আকণ্ঠ ডুবে গিয়েও দ্বিতীয়বারে দল পেতে হয়, তার আইপিএল সমাপতন ঘটে ট্রফিতে চুমু খেয়ে। টাইটান্সকে চ্যাম্পিয়ন করার ক্ষেত্রে তাঁর অনেকটা ভূমিকা রয়েছে। ঋদ্ধিমান সাহার সবচেয়ে বড় সমস্যা, তিনি যে হার মানতেই জানেন না। ভারতীয় ক্রিকেটে যাঁর দরজা আর কোনওদিনও খুলবে না জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তিনি মাটি কামড়ে এমন লড়ার রসদ পান কোত্থেকে! 

ক্রিকেট সার্কিটে চেতেশ্বর পূজারা, ঋদ্ধিমান সাহাদের মতো চরিত্র আজকের দুনিয়ায় বড্ড বেমানান। ক্রিকেট যেমন পালটেছে, ক্রিকেটাররাও নিজেদের সমানুপাতে বদলেছেন। এই পরিবর্তনের জোয়ারে ঋদ্ধিমানরা প্রাচীনপন্থী। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের শীর্ষ পর্যায়ে দীর্ঘদিন খেলার পরেও পা এখনও মাটি স্পর্শ করে থাকে। একটা ঘটনার কথা বলি। ২০১৯-২০ ঘরোয়া ক্রিকেট মরশুম। বাংলা রনজি ট্রফির ফাইনালে উঠল। সৌরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ফাইনালে খেলবেন ঋদ্ধিও। ভারতীয় দলের ক্রিকেটার। ঘরোয়া ক্রিকেটে আন্তর্জাতিক ম্যাচের মতো আঁটসাঁট নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে না। রাজকোটে নেট থেকে বেরিয়ে যাবতীয় কিট বয়ে ড্রেসিংরুমের পথ ধরেছেন ঋদ্ধিমান। মাঝপথে একাধিক সই-শিকারির আবদার। হাত দেখিয়ে অপেক্ষা করার ইঙ্গিত করে ড্রেসিংরুমে মিলিয়ে গেলেন বঙ্গ উইকেটরক্ষক-ব্যাটার। খুদে সই-শিকারিরা হতাশ। ভারতীয় দলের ক্রিকেটার বলে কথা। তাঁর এমন আচরণই তো হওয়া উচিত।

না, এমন ভাবনার স্থায়িত্ব বেশিক্ষণ ছিল না। কয়েক  মিনিট যেতে না যেতেই সাজঘরের দরজা ঠেলে আবদার-করা মুখগুলোকে খুঁজে নিলেন স্বয়ং ঋদ্ধি। তিনি বরাবরের মার্জিত। উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন থেকে আলোকবর্ষ দূরে। কথা বলেন এতই অনুচ্চে যে, তা কোনওক্রমে উলটোদিকে থাকা মানুষটার কান পর্যন্ত পৌঁছায়। শেষ কিছু মাস ধরে নানা ঘটনা তাঁকে তলিয়ে দিয়েছে বিতর্কের অতলে। রবিবার রাতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর সে সবের জবাব দিতেই পারতেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় লম্বা-চওড়া একটা পোস্ট করে। তা একেবারেই ঋদ্ধিমানের স্বভাববিরুদ্ধ। সে পথে হাঁটেননি। ব্যক্তিগতভাবে কোনও উত্তর দেননি। তবে গুজরাট দলকে যারা বিদ্রুপ করেছিল, তাদের একহাত নিয়েছেন। ফাইনাল জিতে বঙ্গ তারকা বলেছিলেন, “এ নিয়ে পঞ্চমবার ফাইনাল খেলছি, দ্বিতীয়বার জিতলাম। কেউ কেউ নিলামের পর বলেছিল, আমাদের দল একেবারেই ভালো হয়নি। তাদের ভুল প্রমাণ করলাম।” চ্যাম্পিয়নরা মরশুম শেষে বাড়ি ফেরার আগে ঋদ্ধির গুণগ্রাহী শিবিরের সকলেই। প্রতিটা পিঠ চাপড়ানো তাঁকে অনিশ্চয়তা থেকে আলো দেখিয়েছে বিদায়বেলায়। তাঁর ভেতরের ক্রিকেট যে শেষ হয়ে যায়নি, এই ধারণাকে আরও দৃঢ় করেছে।

চ্যাম্পিয়ন ঋদ্ধিমানকে নিলামে অদেখা করে দেওয়া নাইট ম্যানেজমেন্ট রবি-রাতে এক গালে থাপ্পড় অনুভব করেছে। আর দ্বিতীয় গালের দায়িত্ব নিয়েছিলেন নাইটদের আরেক প্রাক্তনী শুভমান গিল। তাঁর ম্যাচ উইনিং ছক্কার পরের হুঙ্কার অব্যক্ত অনেক কিছুই বলে গেল।

এত সাফল্যের পরেও আক্ষেপ হয়তো থেকে যাবে ঋদ্ধিমানের। এবং বাংলার ক্রিকেটপ্রেমীদের। তাঁকে যে বাংলার হয়ে খেলতে দেখা যাবে না গত সপ্তাহেই তা নিশ্চিত করে দিয়েছে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল। সিএবি সভাপতি জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁকে রাজি করানোর সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এবং রঞ্জি ট্রফির নকআউট পর্যায়ে খেলতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট চেয়েছেন। ঋদ্ধি আত্মমর্যাদার প্রশ্নে আপস চাননি। অনেকেই তাঁর এই সিদ্ধান্তকে বাড়াবাড়ি মনে করছেন। আরেকটু কি নমনীয় হতে পারতেন না? বাংলার হয়ে রনজিতেও দুরন্ত খেলে অপমানের জবাব আইপিএলের মতো দিতে পারতেন না সিএবি যুগ্ম-সচিব দেবব্রত দাসকে? হয়তো পারতেন। কিন্তু প্রশ্নটা যখন আত্মমর্যাদার, তখন নমনীয়তা দু’পক্ষের কাছেই কাম্য ছিল। সিএবি-র কাছে ঋদ্ধিমান তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা দায়বদ্ধতা প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে পদক্ষেপের অনুরোধ করেছিলেন। সিএবি ক্রিকেটারকে রাজি করানোর চেষ্টা আপ্রাণ করেছে। এ নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। কিন্তু অভিষেক ডালমিয়ারা সরকারিভাবে কখনওই কোনও বিবৃতি দিয়ে বললেন না, দেবব্রত দাসের বক্তব্য নিন্দনীয়। মাঝরাতে ফিরে সকালে অফিস ম্যাচের জন্য যিনি মাঠে পৌঁছে যান, ভারতীয় দল থেকে ফিরে পরেরদিন ক্লাব ক্রিকেটে নেমে যান যিনি, তাঁর দায়বদ্ধতা নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করার স্পর্ধা দেখানো অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। শেষবেলায় এই অপমান তাঁর প্রাপ্য ছিল না।