১৫ বছর ৮ মাস ২৯ দিন অক্ষুণ্ণ ছিল রেকর্ডটা। ২৬ মে ১৯৯৯ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫। দিনের হিসেবে এটা ছিল ৫,৭৫২ দিন।
১৯৯৯-এর সপ্তম বিশ্বকাপে ভারতের জুটির শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে টনটনে ২য় উইকেটে ৩১৮ রানের রেকর্ড গড়ার দিনটা ছিল ২৬ মে ১৯৯৯। ২০১৫র একাদশ বিশ্বকাপে ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে এই রেকর্ড ভেঙ্গে দেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিস গেল (২১৫) ও মার্লন স্যামুয়েলস (অপরাজিত ১৩৩) জুটি জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে মানুকা ওভালে ২য় উইকেটেই ৩৭২ রান যোগ করে। জুটি হিসেবে আজও সৌরভ গাঙ্গুলি ও রাহুল দ্রাবিড়ের ৩১৮ হলো বিশ্বকাপে ২য় সর্বোচ্চ রানের জুটি।
আজ ২৬ মে ২০২২। গাঙ্গুলি-দ্রাবিড় জুটির টনটন তান্ডবের ২৩ বছর পূর্তিতে সেই দিনটা ফিরে দেখা। ২৩ বছর আগের তারিখটাও ছিল ২৬ মে ১৯৯৯। সেটা ছিল অন্য শতাব্দী, অন্য টাইমফ্রেম, অন্য দুনিয়া। সেই দিনটা আজও সুখের স্মৃতি। সেই দিনটা আজও ভুলিয়ে দেয় অনেক না পাওয়া। ১৯৯৯য়ের একদিনের বিশ্বকাপে একটা ম্যাচের জন্য।
১৯৯৯-এর বিশ্বকাপের সময়টা ভারতীয় ক্রিকেটে ছিল পর্বান্তরের সময়। সেবার বিশ্বকাপের জন্য ঘোষিত ১৫ জনের টিমে আগে বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতা ছিল ৭ জনের। তাঁরা হলেন মহম্মদ আজহারউদ্দিন, শচিন তেন্ডুলকার, অজয় জাদেজা, অনিল কুম্বলে, নয়ন মোঙ্গিয়া, ভেঙ্কটেশ প্রসাদ ও জাভাগল শ্রীনাথ। সৌরভ গাঙ্গুলি, রাহুল দ্রাবিড়, অজিত আগরকার, রবিন সিং সমেত বাকি ৮ জন তাঁদের প্রথম বিশ্বকাপের স্বাদ পেতে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন।
সেই বিশ্বকাপে ভারতের প্রথম ম্যাচ ছিল হোভ-এ দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে। ১৫ মে ১৯৯৯ তারিখের সেই ম্যাচে ৩ রানের জন্য শতরান পাননি বিশ্বকাপে নবাগত সৌরভ গাঙ্গুলি। তাঁর ১৪২ বলে ৯৭ ছিল এক দৃষ্টিনন্দন “আসছি” ঘোষণা। অবশ্য তাঁর ৯৭ আর রাহুল দ্রাবিড়ের ৭৫ বলে ৫৪ ভারতকে (৫/২৫৩) সেদিন বাঁচাতে পারেনি। অ্যালান ডোনাল্ড বা শন পোলক নয়, বলে ল্যান্স ক্লুজনারের ৩/৬৬ আর ব্যাটে জ্যাক কালিসের ১২৮ বলে ৯৬-এর পশ্চাদপটে দক্ষিণ আফ্রিকা ১৬ বল বাকি থাকতেই ম্যাচ জিতে নেয়। শুরুতেই বড় ধাক্কা ছিল সেটা, ভারতের জন্য।
প্রথম ম্যাচে হারের পরে আবার একটি বড় ধাক্কা খেয়েছিল ভারত। ১৯শে মে ১৯৯৯ রমেশ তেন্ডুলকরের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে বিশ্বকাপের ভারত-জিম্বাবোয়ে ম্যাচ স্কিপ করে লেস্টার্স থেকে মুম্বাই উড়ে এসেছিলেন তাঁর বিশ্বখ্যাত ক্রিকেটার ছেলে, তাঁর অন্তিম সংস্কারে অংশ নিতে। এবং দ্বিতীয় ম্যাচে ১৯ মে ১৯৯৯ তারিখে লেস্টার্সে জিম্বাবোয়ের হাতে অপ্রত্যাশিত হার হয় ভারতের। কিছুটা দুর্ভাগ্যবশত ধীরে-চলা ওভার রেটের জন্য ৫ ওভার কম ব্যাট করতে বাধ্য হয়েছিল ভারত। ফ্লাওয়ার ভাইদের ৮৫ বলে ৬৮ রান (অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার) ও ৮৯ বলে ৪৫ রান (গ্রান্ট ফ্লাওয়ার) জিম্বাবোয়েকে পৌঁছে দেয় ৯/২৫২ (৫০ ওভার) রানে, যা করার জন্য আম্পায়ারদ্বয় ডেভিড অর্চার্ড ও পিটার উইলি ভারতের জন্য বরাদ্দ করেন ৪৫ ওভার। সদগোপান রমেশের ৭৭ বলে ৫৫ রান আর অজয় জাদেজার ৭৬ বলে ৪৩ ও রবিন সিংয়ের ৪৭ বলে ৩৫ সত্ত্বেও ভারত ঠিক ৪৫ ওভারে ২৪৯ রানে গুটিয়ে যায়।
প্রথম দুটি ম্যাচে হেরে যাওয়া ভারত খুব খারাপ জায়গায় দাঁড়িয়ে, এই অবস্থায় তাঁর মায়ের কথায়, বাবার অন্তিম সংস্কারে অংশ নেওয়ার পরেই শচিন আবার ফিরে গিয়েছিলেন ব্রিস্টলে, পরের ম্যাচেই কেনিয়ার বিরুদ্ধে ভারতের হয়ে খেলার জন্য। আর সেই ম্যাচে করেছিলেন এক অবিস্মরণীয় ১০১ বলে অপরাজিত ১৪০, যা ছিল তাঁর বাবার প্রতি উৎসর্গীকৃত। এর উপর রাহুল দ্রাবিড়ের ১০৯ বলে অপরাজিত ১০৪ ভারতকে ২/৩২৯-এর বিশাল স্কোরে পৌঁছে দেয়। জবাবে দেবাশিস মহান্তির ৪/৫৬-তে ভেঙ্গে পড়ে কেনিয়া ৫০ ওভারে তোলে ৭/২৩৫। এই ফল যেটা জানায় না, তা হল ঐ শচিনের টিমের প্রতি কমিটমেন্ট। কেনিয়ার বিরুদ্ধে অপরাজিত ১৪০ রান করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বাবাকেই হয়ত খুঁজেছিলেন তিনি সেই ২৩ মে ১৯৯৯ তারিখে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে এর পরের ম্যাচে আগের বারের চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ম্যাচ ছিল ভারতের আবশ্যিক জেতার ম্যাচ। প্রাথমিক গ্রুপ লীগের ওই চতুর্থ ম্যাচে টনটন-এ প্রথমে ব্যাট করে ভারত শুরুতেই সদগোপান রমেশকে হারায় নিজের ৫ ও দলের ৬ রানে। এরপরে ২য় উইকেটে ৪৪.৫ ওভারে ৩১৮ রান যোগ করেছিলেন ভারতের জুটি সৌরভ গাঙ্গুলি (১৫৮ বলে ১৮৩, ১৭X৪ আর ৭X৬) এবং রাহুল দ্রাবিড় (১২৯ বলে ১৪৫, ১৭X৪ আর ১X৬)। ৫০ ওভারে ৬/৩৭৩ করে ভারত। জবাবে ৪২.৩ ওভারে ২১৬ রানে মুড়িয়ে যায় শ্রীলঙ্কা। অক্ষম প্রতিরোধের পতাকা তুলেছিলেন শুধু অরবিন্দ ডি’সিলভা ও অর্জুন রণতুঙ্গা, যথাক্রমে ৭৪ বলে ৫৬ ও ৫৭ বলে ৪২ রান করে। রবিন সিং জীবনের সেরা বোলিংয়ে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন ৯.৩ ওভারে ৩১ রান দিয়ে।
সেদিন সৌরভ গাঙ্গুলীর ঐ ১৮৩ই আজও বিশ্বকাপে ভারতের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস। সেদিনের সৌরভ গাঙ্গুলীর ব্যাটিং তান্ডবে টনটন মাঠের পাশে টোন নদীতে উড়ে গিয়েছিল কয়েকটা বল। রানের ফুলঝুরি জ্বালানোর ওই দিনে ১৭ রানের জন্য দ্বিশতরান মিস করে যান সৌরভ গাঙ্গুলি, আর ৫ রানের জন্য ১৫০ রান মিস করে যান রাহুল দ্রাবিড়। সেদিন তাঁরা দুজন মিলে চামিন্ডা ব্যাস ও মুথাইয়া মুরলিথরণসহ শ্রীলঙ্কার বোলারদের প্রায় পাড়ার স্তরে নামিয়ে এনেছিলেন। অতটা অপমান সম্ভবতঃ শ্রীলঙ্কা বোলিং আর কোন দিন, কোন একদিনের ম্যাচে অনুভব করেনি।
২৩ বছর পরে আজও মুখস্থ রয়ে গেছে সেই ম্যাচের প্রতিটি মিনিট। ৩১৮ রানের বিশ্বকাপ জুটির জন্য কুর্ণিশ, সেদিনের সৌরভ গাঙ্গুলি আর রাহুল দ্রাবিড়কে।