বয়স ছিয়াশি। এখনও আম্পায়ারিং করছেন, নিয়মিত!
অদ্ভুত ভাল গল্প। অবশ্য গল্প নয়, ঘটনা। কীথ ডিব তাঁর নাম, ইয়র্কশায়ারীয়। হয়ত ইয়র্কশায়ারের না হলে ক্রিকেট নিয়ে এমন আবেগ দেখানো যায় না। জিওফ্রে বয়কটকে মনে পড়বে ক্রিকেটপাঠকের। বিয়ে না-করে ব্যাট নিয়ে রাতে বিছানায় যেতেন যে!
কীথ ডিবের কাহিনি আকর্ষণীয় শুধুই বয়সের কারণে নয়। শরীরে থাবা বসিয়েছিল বয়স। কাঁধের সমস্যা, অসহনীয় ব্যথা। বিশেষত যে কাজটা করেন, আম্পায়ারিং, কাঁধের বহুল ব্যবহার। ছয় মারল ব্যাটসম্যান, দুটো হাত তুলতে হবে মাথার ওপরে, যন্ত্রণায় কাঁধ ছিঁড়ে যাওয়ার জোগাড়। বাউন্ডারি ‘দেখাতে’ মাথার ওপর হয়ত তুলতে হচ্ছে না হাত, কিন্তু, কাঁধ-সমান উচ্চতায় তুলতে তো হবে, ছড়িয়ে দেখাতে হবে ‘চার’। আর আউট হলে? সেই মাথার ওপর হাত তুলে তর্জনী দেখানো। ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা।
কিন্তু ছাড়বেন কী করে! গত ৭১ বছর ধরে তিনি আম্পায়ার। কাজটা ভালবেসে করেন। অর্থের জন্য নয়। তাই কাঁধে অস্ত্রোপচার করালেন। মাঝে কোভিডকালে কিছু দিন বন্ধ ছিল। সেই কোভিডেই হারিয়েছেন স্ত্রী-কে। এবার আবার ফিরে এলেন মাঠে, সেরে-যাওয়া কাঁধ নিয়ে। দাঁড়িয়ে পড়লেন স্টাম্পের আগে। শুরু আবার, ‘প্লে’!
এমন গল্পগুলো বড় মধুর। হৃদয়ের কাছাকাছি। চন্দ্রবিন্দু যেমন গেয়েছিল, ‘গান ভালবেসে গান’, তেমন। ক্রিকেট ভালবেসে খেলার সঙ্গে থাকা, খেলার কাছাকাছি থাকা তো বটেই, মাঠের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে-থাকা। অন্যতমই বা কেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আম্পায়ার ছাড়া ক্রিকেট হয়!
ছোটবেলায় বোলিং করতেন। ফাস্ট বোলিং। আর ব্যাট করতে নামতেন এগার নম্বরে। মাঝে প্রচুর সময়। ‘কাটে না সময় যখন আর কিছুতেই’, শুরু মাঠের মধ্যেই থাকা। আম্পায়ারিং নিয়ে পড়াশোনা, ক্রমশ প্রেম। তাড়াতাড়িই বুঝে গিয়েছিলেন, ক্রিকেটার হিসাবে মাঠে বেশি দিন থাকা সম্ভব নয়। প্রতিভায় খামতি-কমতি। পরিশ্রমে অনীহা না থাকলেও, ক্রিকেটার হয়ে উঠতে যতটা পথ পেরনো জরুরি, পারবেন না। উপলব্ধি যখন বিশ্বাস, আঁকড়ে ধরা আম্পায়ারিং।
জীবিকার প্রশ্নটা উপেক্ষণীয় নয়। করেননি তাই। ক্রিকেট মাঠ থেকে অনেক দূরের কাজে মনোনিবেশ। শনি-রবি দৌড় ক্রিকেট মাঠে। সাদা কোট সঙ্গী। যে-মাঠে যেখানে ছেলেমেয়ের দল খেলছে, স্বেচ্ছায় দায়িত্ব নিয়ে মাঠে। চার ঘণ্টা হোক বা ছয়-সাত ঘণ্টা, তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে। কচিকাঁচাদের উৎসাহ দিতে, যুবকযুবতীদের ঠিক পথে রাখতে। আদরে-শাসনে বেঁধে রাখা, আর কথায় কথায় ছড়িয়ে দেওয়া ক্রিকেটপ্রেম।
উচ্চতা বরাবরই তাঁর পক্ষে। ছ’ফুট সাড় চার ইঞ্চি। যৌবনে উইকেটের আগে তাঁর, ইংরেজিতে যেমন বলে, ‘টাওয়ারিং প্রেজেন্স’। দেখে মনে হত, পুলিশের চাকরি হয়ত। ফিল্ডার বা বোলাররা জানতেও চাইত। নির্দ্বিধায় জানিয়ে দেন, ‘মিথ্যে বলিনি, সত্যিটা জানাইওনি! পুলিশ জানলে মাঠে বিশৃঙ্খলার সম্ভাবনা কমে যায়। একে পুলিশ তায় ইয়ার্কশায়ারের, মাঠে অসভ্যতা বরদাস্ত করবে না, ধরে নিত সবাই। সুবিধাই হত!’
ডিকি বার্ডের সঙ্গে সেবার বিরাট ঝামেলা। প্রায় মনোমালিন্য! ডিকি বার্ড ফাউন্ডেশনের অর্থসাহায্যের কারণে ম্যাচ। সেখানে খোদ ডিকি-কেই আউট দিয়েছিলেন প্রতারণার কারণে। জানাতে অকপট, এমনভাবে দৌড়চ্ছিলে ডিকি যে বল উইকেটে না-লেগে ওঁর গায়েই লাগছিল। পরিষ্কার প্রতারণা মনে হয়েছিল। তাই আউট দিয়েছিলেন। ডিকি তো রেগে কাঁই! ঝগড়াঝাঁটি, চিৎকার-চেঁচামেচি। ‘এখন অবশ্য ক্ষমা করে দিয়েছে। তবে সে দিন বেশ রেগে গিয়েছিল, সত্যিই।’
১৯৫২ সালে হকসওয়ার্থে একবার বেশ বিড়ম্বনা। ‘ঝুড়ি আর ঝাড়ু নিয়ে মাঠে। সাড়ে তিনটে নাগাদ একদল গরু ফিরে আসত খামারে। লং অফ থেকে ফাইন লেগ পর্যন্ত সরলরেখা ধরে গরুদের ফিরে-আসার পথ। আর যা হয়, মাঠের ওই অঞ্চল গোবরভর্তি। মাঠ পরিষ্কার করার দায়িত্বও পড়ত বেচারা আম্পায়ারের কাঁধেই!’ সাধে কি আর কাঁধের যন্ত্রণা তাঁর!
হাজারেরও বেশি ম্যাচে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেছেন। সেঞ্চুরি থেকে চোদ্দ বছর দূরে দাঁড়িয়েও আবার ফিরছেন সেই কাজে। লন্ডন টাইমস কাগজে ২৬ এপ্রিল পাতার এক চতুর্থাংশ তাই বরাদ্দ কীথ ডিবের জন্য।
ছিয়াশিতেও যাঁর কাঁধ ঝোঁকেনি, ছয়ের সিদ্ধান্ত দেখাতে অস্ত্রোপচার-পরবর্তী কাঁধ নিয়েও যিনি আবার উদ্বাহু!