ড্যানি ওয়াট-এর অসাধারণ শতরান ১২৯ (১২৫) ও সোফি একলেস্টোন-এর ছয়-উইকেটের ওপর ভর করে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ১৩৭ রানে হারিয়ে মহিলা বিশ্বকাপ ২০২২ -এর ফাইনালে পৌঁছে গেল ইংল্যান্ড।
এদিন মেঘাচ্ছন্ন ক্রাইস্টচার্চে টসে জিতে ইংল্যান্ডকে প্রথমে ব্যাট করতে পাঠায় দক্ষিণ আফ্রিকা। তিন ওভার দুই বলের মাথায় ইংল্যান্ডের অভিজ্ঞ ডানহাতি ওপেনার টেমি বিউমন্ট ৭ (১৪)-কে সাজঘরে ফিরিয়ে ভালো শুরুও করে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং আবহাওয়া ও বাউন্সযুক্ত উইকেটের সুযোগ কাজে লাগিয়ে আরও দুটি উইকেট তুলে নেয় প্রথমের দিকেই। কিন্তু গতকাল উইন্ডিজের মতো আজও ক্যাচ মিসের খেসারত দিতে হলো দক্ষিণ আফ্রিকাকে। নিজের প্রথম বিশ্বকাপ সেঞ্চুরির পথে তিনবার — ২২, ৩৬, ৭৭ ও সেঞ্চুরির পরে ১১৬, ১১৭ রানের মাথায় সর্বমোট পাঁচ-পাঁচবার জীবন ফিরে পান ড্যানি ওয়াট প্রোটিয়াদের জঘন্য ফিল্ডিং বদান্যতায়। এরমধ্যে মিডিয়াম পেসার আয়াবঙ্গা খাকা-র ওভারে (৪১ তম ওভার) তো দু-দুবার ওয়াটের ক্যাচ মিস করেন অভিজ্ঞ শাবনিম ইসমাইল ও মিগনন দু প্রেজ।
প্রোটিয়া বোলারদের মধ্যে মারিজান কাপ তাঁর ওপেনিং স্পেলের ৪ ওভারে মাত্র ছয়রান দিয়ে ও ইংল্যান্ডের ডানহাতি ওপেনার টেমি বিউমন্ট-এর উইকেট তুলে নিয়ে দুর্দান্ত শুরু করেন। অভিজ্ঞ প্রোটিয়া মিডিয়াম পেসার মাসাবাতা ক্লাস তাঁর স্পেলের শুরুতেই ওয়াট-কে আউট করার সুযোগ পেলেও, ফার্স্ট স্লিপে থাকা লিজেল্লে লি ওয়াটের ব্যাট ছুঁয়ে যাওয়া লো ক্যাচটি ধরতে না পারলে বল গড়িয়ে যায় বাউন্ডারির দিকে। পাওয়ার-প্লে শেষে ইংল্যান্ডের স্কোর দাঁড়ায় এক উইকেট হারিয়ে ৪৪। এরপর ইংল্যান্ড অধিনায়িকা হিথার নাইট ১ (১৯) নামলেও নিজের স্বভাববিরুদ্ধ ভঙ্গিতে অতিরিক্ত ডট বল খেলে আয়াবঙ্গা খাকার বলে লেগ বিফোর হয়ে সাজঘরে ফেরেন। হিথারের পর ন্যাট স্কিভার-ও বেশীক্ষণ স্থায়ী হতে পারেননি উইকেটে – ১৮ বলে ১৫ রান করে অভিজ্ঞ পেসার শাবনিম ইসমাইলের বলে পুল করতে গিয়ে ধরা দিয়ে বসেন মারিজান কাপ-এর হাতে – স্কোরবোর্ডে তখন ইংল্যান্ড – ৭৭/৩ (১৭.১)।
এরপর উইকেট-রক্ষক এমি জোনস-এর সাথে চতুর্থ উইকেটে ৫১ বলে ৪৯ রানের একটি পার্টনারশিপ গড়ে তুলে ২৬ ওভারের মধ্যে ইংল্যান্ডের স্কোর ১২৫ রানে পৌঁছে দেন ওপেনার ড্যানি ওয়াট। এইসময় দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়িকা সুন লুস আবার মারিজান কাপ-এর হাতে বল তুলে দিলে, তিনি তাঁর দ্বিতীয় উইকেটটি তুলে নেন এবং ওয়াট-জোনস জুটি ভেঙে দেন জোনস ২৮ (৩২)-কে সাজঘরে ফিরিয়ে। দিনভর ফিল্ডিং ব্যর্থতার মাঝেও মিড উইকেটে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্লো ট্রায়ন ভালো ক্যাচটি নেন। ইংল্যান্ডের স্কোর তখন ১২৬/৪ (২৫.৪)। তবে একের পর এক উইকেট পড়তে থাকলেও ওয়াট প্রায় ৯০ স্ট্রাইক রেটে খেলতে থাকায় ইংল্যান্ডের রান-রেট কখনোই খুব একটা নেমে যায়নি। এদিন ওয়াট-এর ব্যাট থেকে আসা কাট শটগুলি ছিল দেখার মতো, যা থেকে সর্বমোট ৩৪ রান আসে ওয়াট-এর ১২৯ রানের মধ্যে।
এমি জোনস সাজঘরে ফিরলে সোফিয়া ডাঙ্কলে নামেন এবং এতক্ষণে ওয়াট খুঁজে পান তাঁর যোগ্য সঙ্গীকে। দুজনে মিলে পঞ্চম উইকেটে ১১৬ রান যোগ করে চাপ ফিরিয়ে দেন দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে। ওয়াট তাঁর অর্ধ-শতরান পূর্ণ করতে ৫৬ টি বল খেললেও, শতরান পূর্ণ করেন আর মাত্র বত্রিশটি বল খেলে। পুরো ইনিংসে একটিও ওভার বাউন্ডারি না মারলেও বারোটি বাউন্ডারি হাঁকান তিনি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের পর ইংল্যান্ডের হয়ে এটিই ছিল তাঁর প্রথম শতরান এবং এই শতরানের মাধ্যমে তিনিই হলেন একমাত্র মহিলা যিনি ইংল্যান্ডের হয়ে নক-আউট স্টেজে শতরান করার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করলেন। শতরান পূর্ণ করার পর দক্ষিণ আফ্রিকা তাঁকে আউট করার সুযোগ পেলেও আরও দুবার জীবন ফিরে পান ওয়াট। কিন্তু এরপর আর বেশীক্ষণ স্থায়ী হতে পারেননি তিনি, ৪৫ তম ওভারে মাসাবাতা ক্লাসের বলে লিজেল্লে লি মুঠোবন্দী করে ফেলেন তাঁকে। আউট হয়ে ফেরার সময় পুরো ইংল্যান্ড ডাগ-আউট উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানায় তাঁকে, সাথে দক্ষিণ আফ্রিকার খেলোয়াড়রাও অভিবাদনসূচক হাত মেলায় তাঁর সাথে। এরপর ডাঙ্কলি তাঁর অর্ধশতরান পূর্ণ করেন ৬২ বলে এবং ৭২ বলে ৬০ রানের একটি প্রয়োজনীয় ইনিংস খেলে সাজঘরে ফেরেন এই তরুণী ইংল্যান্ড অলরাউন্ডারটি। অবশেষে সোফি একলেস্টোন ১১ বলে পাঁচটি বাউন্ডারি সহযোগে ২৪ রান করে ইংল্যান্ডকে পৌঁছে দেন এবারের প্রতিযোগিতায় তাদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ টোটালে – ২৯৩/৮ (৫০)। শেষ দশ ওভারে ৭৫ রান বোর্ডে যোগ করে ইংল্যান্ড। দক্ষিণ আফ্রিকার বোলারদের মধ্যে সবথেকে বেশি – তিনটি – উইকেট পান শাবনিম ইসমাইল এবং মারিজান কাপ ও মাসাবাতা ক্লাস উভয়েই ২ টি করে উইকেট নেন।
দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ফাইনালে পৌঁছতে হলে এই সুবিশাল রান – যা হতো তাদের সর্বাধিক রান তাড়া – স্কোরবোর্ডে তুলতে হতো। যা একেবারেই সহজ কাজ ছিল না এবং ইনিংস বিরতির পর ব্যাট করতে নামলে প্রথমেই এবারের প্রতিযোগিতায় সর্বাধিক রান সংগ্রহকারী ও বিশ্ব ক্রমতালিকায় প্রথম স্থানে থাকা তরুণী প্রোটিয়া ওপেনার লরা উলভার্ট-কে হারিয়ে চাপে পড়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ২০১৭ মহিলা বিশ্বকাপ ফাইনালের প্লেয়ার অফ দ্য ম্যাচ অভিজ্ঞ ইংল্যান্ড পেসার অ্যানিয়া শ্রাবসোল তাঁকে কট অ্যান্ড বোল্ড করেন নিজের প্রথম ওভারের দ্বিতীয় বলেই এবং নিজের দ্বিতীয় ওভারে আরেক প্রোটিয়া ওপেনার লিজেল্লে লি, যিনি নিজের শততম ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছিলেন, তাঁকে ঘায়েল করেন ইনস্যুইঙ্গার দ্বারা। লি বুঝতে না পেরে ১৫ বলে মাত্র ২ রান করে ধরা পড়ে যান মিড-উইকেটে দাঁড়ানো স্কিভার-এর কাছে। ২৯৪ রান তাড়া করতে নেমে দক্ষিণ আফ্রিকা তখন ৮/২ তিন ওভার ছয় বলে। প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে বাঁহাতি ব্যাটার লারা গুডঅল ও অধিনায়িকা সুন লুস কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। পাওয়ার প্লে শেষে দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোর দাঁড়ায় ৩৭/২। কিন্তু এই প্রতিরোধ বেশীক্ষণ টিকিয়ে রাখতে পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকা কারণ শীঘ্রই পেসার কেট ক্রস তাঁর পঞ্চম বলে নিজের শততম ওয়ানডে ম্যাচ খেলতে নামা প্রোটিয়া অধিনায়িকা সুন লুস-এর ২১ (২৪) স্টাম্পস ছিটকে দেন।
লারা গুডঅল-ও আর বেশিক্ষণ নিজের ইনিংসকে দীর্ঘায়িত করতে পারেননি। অফস্পিনার চার্লি ডিন-কে স্কুপ করতে গিয়ে পুরোপুরিভাবে বলটি মিস করেন তিনি এবং ৪৯ বলে ২৮ রান করে ফিরে যান সাজঘরে। মিগনন ডু প্রেজ ও মারিজান কাপ-এর ওপর পার্টনারশিপ গড়ে তোলার দায়িত্ব এসে পড়লেও বাঁহাতি স্পিনার সোফি একলেস্টোন-এর সামনে আর কেউ দাঁড়াতে পারেননি। মহিলা ক্রিকেটে বর্তমানে বিশ্বের এক নাম্বার বোলার প্রথম উইকেটটি তুলে নেন তাঁর দ্বিতীয় ওভারে মারিজান কাপ-কে বোল্ড করে। সেই শুরু এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি বছর বাইশের তরুণীকে। একের পর এক ক্লো ট্রায়ন, মিগনন ডু প্রেজ, শাবনিম ইসমাইল, মাসাবাতা ক্লাস ও তৃষা ছেত্তি অসহায় আত্মসমর্পণ করেন তাঁর স্পিন ভেল্কির সামনে। প্রোটিয়া স্পিডস্টার শাবনিম ইসমাইল-কে আউট করার পর ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বিশেষ ভঙ্গিতে একলেস্টোন-এর সেলিব্রেশনের ছবি বেশ ভাইরাল হয় আজ নেটদুনিয়ায়। প্রথমে ব্যাট হাতে ড্যানি ওয়াট-এর দুর্দান্ত পারফরম্যান্স ও পরে বল হাতে একলেস্টোন-এর নিজের প্রথম পাঁচ-উইকেট সংগ্রহ করার পাশাপাশি ৩৬ রানের বিনিময়ে ৬ উইকেট – যা ছিল তাঁর বেস্ট ফিগার ওয়ান ডে ক্রিকেটে এবং এবারের বিশ্বকাপের ও বেস্ট ফিগার – ইংল্যান্ডকে এনে দেয় ১৩৭ রানের ব্যবধানে বিশাল জয় এবং চিরশত্রু অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ফাইনালের টিকিট।
এবারের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড প্রথম তিনটি ম্যাচে হেরে যাবার পর কেউই তাদের ধর্তব্যের মধ্যে রাখেননি। কিন্তু গতবারের বিশ্বজয়ীরা এত সহজে হাল ছেড়ে দেয়নি বরং তিনটি ম্যাচ হারার পর থেকে পরবর্তী ম্যাচগুলিকে নক–আউট হিসেবে নেয় এবং এখন চ্যাম্পিয়নশিপ ডিফেন্ড করার ক্ষেত্রে আরও একধাপ এগিয়ে গেল তারা। আগামী রবিবার, ৩ রা এপ্রিল ক্রাইস্টচার্চে টুর্নামেন্ট ফেভারিট অস্ট্রেলিয়া অপেক্ষা করবে তাদের জন্য। শেষ হাসি কারা হাসে সময়ই তার উত্তর দেবে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
ইংল্যান্ড – ২৯৩/৮ (৫০) – ড্যানি ওয়াট ১২৯ (১২৫), সোফিয়া ডাঙ্কলে ৬০ (৭২), সোফি একলেস্টোন ২৪ (১১); শাবনিম ইসমাইল ১০-০-৪৬-৩।
দক্ষিণ আফ্রিকা – ১৫৬/১০ (৩৮) – মিগনন ডু প্রেজ ৩০ (৪৮); সোফি একলেস্টোন ৮-০-৩৬-৬।
ইংল্যান্ড জয়ী ১৩৭ রানে।
ম্যাচের সেরা – ড্যানি ওয়াট।