“জাতীয় দল? সত্যিই? কিংসমিডে? টিকিট পাওয়া যাবে?” — আপামর ডারবানবাসীর মনে এখন এই একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আর হবে নাই বা কেন কতদিন পর জাতীয় দলের ম্যাচ ফিরছে বলুন তো ডারবানে? তখন পৃথিবীতে মাস্ক, স্যানিটাইজার, দূরত্ব-বিধি, লকডাউন ইত্যাদি শব্দবন্ধের বহুল প্রচলন ছিলনা। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বৃষ্টিতে বন্ধ হয়ে যাওয়া ওয়ান-ডে ম্যাচের পর থেকে ডারবান জাতীয় দলের মুখ অবধি দেখেনি আর লাল-বলের ক্রিকেট? সেটাও শেষবার হয়েছে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তারপর থেকে সমগ্র বিশ্ব দেখেছে করোনা মহামারীর ভয়াল রূপ। তা এতকিছু ঘটে গেছে মাঝখানে যে ডারবানবাসীর অবাক হওয়া স্বাভাবিকই। তবে শুধু যে মহামারীর কারণেই ডারবান বঞ্চিত হয়েছে জাতীয় দলের ম্যাচ আয়োজনের থেকে তা নয়। কোভিড তো একটা কারণ বটেই তবে তার সাথে জুড়েছে কিংসমিডে ম্যাচ খেলার প্রতি জাতীয় দলের তীব্র অনীহা। একটা সময় ছিল যখন কিংসমিডের আউটফিল্ড আর পিচ আলাদা করা যেত না পিচের মধ্যে স্টাম্পসগুলি না থাকলে। অর্থাৎ এতটাই সবুজে ভরপুর থাকত কিংসমিডের পিচ যে তা ফাস্ট বোলারদের জন্য হয়ে উঠত স্বর্গ আর ব্যাটসম্যানদের জন্য বধ্যভূমি। তা সময় বদলেছে, যুগ বদলেছে, বদলেছে কিংসমিডের পিচের চরিত্রও। নব্বইয়ের দশকের সেই কিংসমিড এখন আর নেই। পেস-বাউন্সি উইকেট ছেড়ে বিগত কয়েক বছরে কিংসমিড হয়ে উঠেছে স্পিন সহায়ক উপমহাদেশের স্লো উইকেট। এছাড়াও সাম্প্রতিক কালে ডারবানে দক্ষিণ আফ্রিকার রেকর্ড ও তাদের অনীহার অন্যতম আরেকটি কারণ।
২০০৯ সাল থেকে ডারবানে নয়টি টেস্টের মধ্যে মাত্র একটিতে জয় পেয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা (ভারতের বিপক্ষে, ২০১৩ সালে)। তারপর থেকে ভারত, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড — সকলের বিরুদ্ধেই ডারবান দিয়েছে পরাজয়ের গ্লানি। শ্রীলঙ্কা তো আবার ২০১৯ সালে প্রথম এশীয় দল হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে টেস্ট সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব অর্জনও করে যার সূচনাও হয়েছিল এই ডারবানের মাটিতেই। তাহলেই বলুন তো, জাতীয় দল কেন মুখ ফিরিয়ে থাকবেনা কিংসমিডের থেকে?
তা যাইহোক দীর্ঘদিন পর কোভিড পরিস্থিতি কাটিয়ে ক্রিকেট ফিরছে ডারবানে। এটাই বড়ো কথা ডারবানবাসীর কাছে। মহামারীকে পিছনে ফেলে ধীরে ধীরে ছন্দে ফিরছে দক্ষিণ আফ্রিকা। শিথিল থেকে শিথিলতর করা হচ্ছে কোভিডকালীন নিয়মাবলী। ৫০% শতাংশ দর্শক প্রবেশের অনুমতি পেয়েছে স্টেডিয়ামগুলি, সাথে আরও সংযোজন মাঠ সংলগ্ন পানশালাগুলিও খোলা যাবে যা বন্ধ ছিল ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে। সবমিলিয়ে ডারবানে এখন সাজো সাজো রব বহু প্রতীক্ষার পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রত্যাবর্তনে।
আর এই বদলে যাওয়া সময়ে কিংসমিডও নাকি ফিরছে তার পুরাতন রূপে। এবার নাকি পরিস্থিতি অন্যরকম। এমনটাই বলছেন অন্তত স্বয়ং অধিনায়ক ডিন এলগার ও অলরাউন্ডার কেশব মহারাজ। দুজনেই নাকি কথাটথা বলে জেনেছেন বাংলাদেশ সিরিজের প্রথম টেস্টের জন্য যে পিচখানা বানানো হচ্ছে তাতে যথেচ্ছ পরিমাণে ঘাস রাখা হচ্ছে। ঘরোয়া দলের আস্থা পুনরায় অর্জন করতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখছে না কিংসমিডের মাঠকর্মীরা এমনটাই শোনা যাচ্ছে কান পাতলে।
দুটি ড্র ও দশটি ম্যাচে পরাজয় — এই হচ্ছে বাংলাদেশের টেস্ট রেকর্ড দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে যা একেবারেই আশাব্যঞ্জক কিছু নয়। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে তো ছয়টার মধ্যে ছয়টা টেস্টই হেরেছে পদ্মাপারের দেশটি যার মধ্যে পাঁচটিতে জুটেছে লজ্জার ইনিংসে পরাজয় ও একটিতে ৩৩৩ রানে। কিন্তু পুরনো রেকর্ড দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিকে বিচার করলে ভুল হবে। কারণ এই বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকা কে তাদের দেশেই ওয়ান-ডে সিরিজে হারিয়ে (২-১) রেকর্ড গড়েছে এই সফরেই। এর আগে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে ঘরোয়া সিরিজে জয়লাভ করেছে ও বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী কিউয়িদের আট উইকেটে হারিয়ে অশ্বমেধের ঘোড়ার মতো ছুটছে এখন বাংলাদেশ।
ব্যাটিংয়ে তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসানদের মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের উপস্থিতি বাংলাদেশকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে। যদিও পারিবারিক কারণে প্রথম টেস্টে সাকিবকে না পেলেও আগামী ৭ই এপ্রিল সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে পোর্ট এলিজাবেথে ফিরবেন সাকিব। আর বোলিং বিভাগে তাসকিন আহমেদ, এবাদত হোসেনদের মতো ফাস্ট বোলারদের দিকে তাকিয়ে থাকবেন বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক মোমিনুল হক, বল হাতে যাঁদের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স মুগ্ধ করেছে সমগ্র ক্রিকেট বিশ্বকে। তামিম ইকবাল, তাসকিন আসমেদ, মেহেদি হাসান — এঁদের তিনজনই বাংলাদেশকে তাদের প্রথম কোনো ফরম্যাটে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক জয় তুলে আনতে সাহায্য করেছিলেন (ওয়ান-ডে সিরিজ জয়, ২-১) যা মানসিকভাবে অনুপ্রাণিত করবে বাংলাদেশ দলকে। এছাড়াও বাংলাদেশের কোচিং বিভাগে আছেন সর্বকালের অন্যতম বিখ্যাত দক্ষিণ আফ্রিকান পেস কিংবদন্তি অ্যালান ডোনাল্ড, শ্রীলঙ্কার স্পিন কিংবদন্তি রঙ্গনা হেরাথ (যিনি ২০১১ সালে এই ডারবানেই ১২৮ রানের বিনিময়ে ৯ উইকেট নিয়ে শ্রীলঙ্কাকে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে তাদের প্রথম জয়ের স্বাদ দিয়েছিলেন) ও আরেক বিখ্যাত দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট কোচ রাসেল ডোমিঙ্গো, যিনি বাংলাদেশের হেডকোচ এবং হাতের তালুর মতো চেনেন দক্ষিণ আফ্রিকা তথা কিংসমিডের মাটি। তাই ম্যাচে নামার আগে বেশ দৃশ্যতই বেশ গোছানো এবং আত্মবিশ্বাসী লাগছে টিম মোমিনুল কে।
অন্যদিকে নিজেদের ঘরের মাটিতেই কার্যত বিপাকে দক্ষিণ আফ্রিকা কারণ জাতীয় দলের ছয়জন অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের ছাড়াই মাঠে নামতে হবে তাদের। ঠিক যখন কেশব মহারাজ, এলগারদের মতো ডারবানের ঘরের ছেলেরা বলছেন যে, এবারের ডারবান উইকেট অন্যরকম হতে চলেছে। এমন ঘাস আগে কখনও দেখেননি তাঁরা, তখনই দক্ষিণ আফ্রিকা পাবেনা কাগিসো রাবাদা, লুঙ্গি এনগিডি, মার্কো জেনসেনদের মতো প্রথম সারির ফাস্ট বোলারদের, যাদের প্রত্যেকেই বছরের শুরুর দিকে ভারতের বিপক্ষে সিরিজ জয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। এনরিখ নর্তজে আগেই ছিটকে গেছেন চোটের কারণে। সাথে ব্যাটিংয়েও শূন্যতা সৃষ্টি হবে এইডেন মারক্রম, রাসি ফান ডার ডাসেনদের মতো অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানদের অনুপস্থিতিতে। কারণ এঁরা সবাই জাতীয় দলের আগে আইপিএল কে প্রাধান্য দিয়েছেন। সর্বমোট পাঁচজন প্রথম সারির খেলোয়াড় কে আইপিএলের জন্য পাবেনা দক্ষিণ আফ্রিকা। যার ফলে ব্যাটিং থেকে বোলিং সব বিভাগেই অভিজ্ঞতার অভাব বোধ করবে প্রোটিয়ারা। তাই বোলিংয়ে লুথো সিপামলা, ডুয়ানে অলিভিয়ার ও ব্যাটিংয়ে ডিন এলগার, টেম্বা বাভুমাদের বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে এবং সঠিকভাবে নেতৃত্ব প্রদান করতে হবে রায়ান রিকলেটন, খায়া জোন্দো, লিজাড উইলিয়ামস, ড্যারেন ডুপাভিলনদের মতো একঝাঁক অনভিজ্ঞ-আনক্যাপড খেলোয়াড়দের। যা নিঃসন্দেহে কঠিন চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে অধিনায়ক ডিন এলগারের সামনে। তবে প্রথম সারির খেলোয়াড়দের অনুপস্থিতিতে এই সিরিজে ভালো খেলে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করার সুবর্ণ সুযোগ পেতে পারেন কিগান পিটারসন, খায়া জোন্দোদের মতো তরুণ প্রতিভাবান ক্রিকেটাররা।
এখনও অবধি বছরটা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে গেছে দক্ষিণ আফ্রিকার। ভারতের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে জয়লাভ যদি তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলে থাকে, তাহলে বাংলাদেশের মতো দলের কাছে দেশের মাটিতে ওয়ান-ডে সিরিজ খুইয়ে তা নিম্নমুখীও হয়ে থাকতে পারে। বর্তমানে ২০২৩ বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পয়েন্টস টেবিলে দক্ষিণ আফ্রিকা রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে। বাংলাদেশকে হোয়াইট ওয়াশ করতে পারলে শীর্ষস্থানে থাকা অস্ট্রেলিয়ার অনেকটাই কাছে পৌঁছে যাবে তারা। উল্টোদিকে পাকিস্তানের বিপক্ষে হেরে ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ড্র করে বাংলাদেশ বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পয়েন্টস টেবিলে যতই আট নাম্বার স্থানে থাকুক না কেন এবং কিংসমিড তার চরিত্র বদলে যতই পেস সহায়ক হয়ে উঠুক না কেন, বাংলাদেশকে হারানো যে মোটেই সহজ হবেনা তা খুব ভালো করেই জানে প্রোটিয়াবাহিনী। এর আগে ২০১৭-১৮ সালে দুই দেশ শেষবার মুখোমুখি হয়েছিল লাল-বলের ক্রিকেটে। সেবার সফরকারী দল বাংলাদেশকে হোয়াইট-ওয়াশ করে ২-০ সিরিজ জেতে দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে টাইগাররা এখন প্রকৃতপক্ষেই টাইগার। যতদিন যাচ্ছে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে তারা। আর এবারে সদ্য ওয়ানডে সিরিজ জয়ের সাথে সাথে আরও কতগুলো কাকতালীয় ব্যাপার ভরসা জোগাতে পারে তাদের —
১) বিগত এগারোটি টেস্ট সিরিজের মধ্যে সাতবার সিরিজের প্রথম টেস্ট ম্যাচে হেরেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। অতি সাম্প্রতিক কালে ভারতের বিরুদ্ধে গতবছর ডিসেম্বরে ও এইবছর ফেব্রুয়ারীতে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ক্রাইস্টচার্চে।
২) যে দুটি মাঠে বাংলাদেশ খেলবে — কিংসমিড ও পোর্ট এলিজাবেথ, এই দুটিতেই ২০১৯ সালে জয়লাভ করে প্রথম এশীয় দল হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকায় টেস্ট সিরিজ পকেটে ঢোকায় শ্রীলঙ্কা। এখন দেখার দ্বিতীয় এশীয় দল হিসেবে এই বিরল কৃতিত্বের অধিকারী হতে পারেন কিনা টাইগাররা।
তাই সবমিলিয়ে উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশ দলে এখন একটাই ডাক — হয় এবার, নয়তো নেভার।
দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম বাংলাদেশ সিরিজ:
প্রথম টেস্ট – ৩১শে মার্চ–৪ঠা এপ্রিল, ডারবান।
দ্বিতীয় টেস্ট – ৮ই এপ্রিল–১২ই এপ্রিল, পোর্ট এলিজাবেথ।
ছবি : ইন্টারনেট