৩৭ বছর আগের একটি ছোট স্কোরের ম্যাচ

বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১৯য়ের…

১) ৫ই জুন ২০১৯য়ের ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ।

২) ১৯শে জুন ২০১৯য়ের নিউজিল্যান্ড বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ।

৩) ২১শে জুন ২০১৯য়ের শ্রীলঙ্কা বনাম ইংল্যান্ড ম্যাচ এবং

৪) ২২শে জুন ২০১৯য়ের ভারত বনাম আফগানিস্থানের এপিক ম্যাচ।

বড় স্কোরের ২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে ২২শে জুন ২০১৯ অবধি এই চারটি ম্যাচ ছিল ব্যতিক্রম।

অনেকেই তখন বলেছিলেন এই ম্যাচগুলোতে নব্বই দশকের ওডিআই লড়াইর ফ্লেভার ছিল। সেই বোলারদের দাপট। সেই ফিল্ডারদের রমরমা। সেই প্রতিটি রান বাঁচানোর জন্য প্রাণান্তকর লড়াই। সেই প্রতিটি উইকেট দখলের লড়াইতে “সূচ্যগ্র মেদিনী” না ছাড়া।

এই প্রেক্ষাপটে চলুন নব্বই দশক থেকে আরো একটু পিছিয়ে গিয়ে একটা খুব ছোট্ট স্কোরের একটা খেলায় দর্শক হয়ে যাই টাইম মেশিনে চড়ে।আশির দশকের মাঝামাঝি, ১৯৮৫র ২২শে মার্চে ফিরে যাব এখন।মানে আজ থেকে ঠিক ৩৬ বছর আগের একটা ম্যাচ দেখে আসি সবাই।

শারজা-তে রথম্যানস কাপের প্রথম খেলা ভারত বনাম পাকিস্তান ম্যাচ। তার ঠিক ১২ দিন আগে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ণে ভারত এই পাকিস্তানকেই হারিয়ে বেনসন হেজেস কাপ জিতে এসেছে আর পাকিস্তান তখন ছিল বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্রিকেট টিম।

৫০ ওভারের খেলাটা শুরু হতে যাচ্ছে এইবার। টসে জিতে ইমরান খান ভারতকে ব্যাট করতে দিলেন। নিজে প্রথম বল করতে এলেন। এবং রবি শাস্ত্রীকে প্রথম বলে এল বি ডবলু আউট করলেন।দলের ১২ রানে নিজের ৫ বল খেলে ৬ রানে ফিরে গেলেন কৃষ্ণমাচারী শ্রীকান্ত, ইমরান খানেরই বলে ডিপ স্কোয়ার লেগে ক্যাচ নেন সেলিম মালিক।একটু পরেই ভারত ৩ উইকেটে ২০। ৪ বলে ১ রান করে ইমরান খানের তৃতীয় শিকার দিলীপ বেঙ্গসরকার, উইকেটকিপার আশরফ আলির হাতে ক্যাচ দিয়ে। অচিরেই ৪ উইকেটে ২৮ এবং ৫ উইকেটে ৩৪।ইমরান খানের চতুর্থ আর পঞ্চম শিকার, আশরফ আলির হাতে ক্যাচ দিয়ে সুনীল গাভাসকার (৯ বলে ২) আর মহিন্দার অমরনাথ (১০ বলে ৫) বোল্ড। অন্যদিকে মরিয়া লড়াই দেওয়া মহম্মদ আজহারউদ্দিন এবং স্বভাবসিদ্ধ আক্রমণাত্মক অধিনায়ক কপিলদেব (৪টি চার সহ ৪৪ বলে ৩০) ৮০ অবধি পৌঁছে দেন ভারতকে। ৬ উইকেটে ৮০ হয়, যখন কপিলদেব বোল্ড হয়ে যান তৌসিফ আহমেদের অফস্পিনে।এরপর রজার বিনি (১৯ বলে ৮ করে কট জাভেদ মিয়াঁদাদ বো মুদাসসর নজর) আর মদনলালকেও (৩৯ বলে ১১ করে কট আশরফ আলি বো ইমরান খান) ফিরে যেতে দেখেন মহম্মদ আজহারউদ্দিন। ৭ উইকেটে ৯৫ হয়ে ভারত পৌঁছে যায় ৮ উইকেটে ১১৩ রানে। দলের ১২১ রানে ফেরেন মহম্মদ আজহারউদ্দিন (৩টি চার সহ ৯৩ বলে ৪৭) তৌসিফ আহমেদের বলে বোল্ড হয়ে। ওয়াসিম আক্রামের বলে সেলিম মালিকের হাতে ক্যাচ দিয়ে লক্ষ্মণ  শিবরামকৃষ্ণণ (৬ বলে ১) ফিরে যেতেই ভারতের ইনিংস শেষ হয়ে যায় ১২৫ রানে, ৪২ ওভার ৪ বলে। অসম্ভব লড়ে ২৮ বলে ৩ রান করে অপরাজিত থেকে যান উইকেটরক্ষক সদানন্দ বিশ্বনাথ।ভারতীয় ইনিংসে ধ্বংসের মূল হোতা ছিলেন ইমরান খান (১০-২-১৪-৬)। তৌসিফ আহমেদ (১০-০-২৭-২) যোগ্য সঙ্গত করেন তাঁকে।ওয়াসিম আক্রাম আর মুদাসসর নজর ১টি করে উইকেট নেন যথাক্রমে ২৭ আর ৩৬ রান দিয়ে। উইকেটকিপার আশরফ আলি নেন ৩টি ক্যাচ। ইনিংসে। সব মিলিয়ে মোট ১১টি বাউন্ডারি হয় ভারতীয় ইনিংসে।

১২৫ রানের মূলধন নিয়ে ভারত কতদূর লড়াই দেবে শক্তিশালী পাকিস্তানকে, এ চিন্তা করাই ছেড়ে দিয়েছিলেন ভারতের সমর্থকরা। তাঁরা ভাবছিলেন, পাকিস্তানের জয় শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু কপিলের একাদশ ভেবেছিলেন অন্য কিছু। ৩৬ বছরের সুনীল গাভাসকার ৪টি ক্যাচ নিয়ে ওই গ্রীষ্মের দিনটিকে পরিবর্তিত করে ফেলেন তাঁর স্লিপ-ফিল্ডিং জীবনের বসন্তদিনে। কপিলদেব ৩টি (৬.৫-১-১৭-৩), রজার বিনি (৩-০-২৪-১) আর মদনলাল ১টি করে (৬-২-১২-১) এবং রবি শাস্ত্রী (১০-৫-১৭-২) আর লক্ষ্মণ শিবরামকৃষ্ণণ (৭-২-১৬-২) ২টি করে উইকেট নেন ওই ইনিংসে।সব মিলিয়ে মোট মাত্র ৫টি বাউন্ডারি হয় পাকিস্তান ইনিংসে।

তিন নম্বর খেলোয়াড় রামিজ রাজা উল্টো দিকে ৫ জনকে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে দেখেন । যখন ওপেনার মহসীন খান রান আউট হন তখন পাকিস্তান ১ উইকেটে ১৩। সেখান তারা থেকে ২ উইকেটে ৩৫ হয়ে যায় যখন অপর ওপেনার মুদাসসর নজর ফিরে যান ২টি চারসহ ১৮ বলে ১৮ রান করে বিনির বলে স্লিপে গাভাসকারের হাতে ধরা পড়ে। ডানদিকে ঝাঁপিয়ে এক হাতে নেওয়া ওই ক্যাচটি ছিল চোখের আরাম।গাভাসকারের এর পরের ক্যাচটি ছিল আরো অসাধারণ এবং রোমহর্ষক, আরো নীচু এবং ওই এক হাতেই নেওয়া। ওই ক্যাচে শূন্য রানে (১৫ বলে) ফিরে যান ব্যাটিং ত্রাস জাভেদ মিয়াঁদাদ, রবি শাস্ত্রীর বলে এবং পাকিস্তান ৩ উইকেটে ৪০ হয়ে যায়। তারপরে খুব দ্রুত তারা ৪ উইকেটে ৪১ হয়ে ৫ উইকেটে ৪১ হয়ে যায়।আশরাফ আলি (কট দিলীপ বেঙ্গসরকার) আর ইমরান খান (স্টাম্পড সদানন্দ বিশ্বনাথ), দুজনেরই উইকেট নেন লক্ষ্মণ শিবরামকৃষ্ণণ এবং দু’জনেই খাতা খুলতে ব্যর্থ হন। এখান থেকে সেলিম মালিকের (৩৯ বলে ১৭) হাল্কা প্রতিরোধ শেষ হয় কট গাভাসকার বো রবি শাস্ত্রী হয়ে। নীচু কিন্তু রেগুলেশন ক্যাচ ছিল এটা। ৬ উইকেটে ৭৪ হয় স্কোর। রামিজ রাজার ৭১ বলে ২৯ রানের প্রতিরোধ যখন ভাঙ্গে, স্কোর তখন ৭ উইকেটে ৮৫। কপিলদেবের বলে সেই গাভাসকার তাঁর চতুর্থ এবং এদিনের সহজতম ক্যাচ নেন। আর দু’রানের মধ্যে গুটিয়ে যায় পাকিস্তান ইনিংস। তিনটি উইকেটই পড়ে ৮৭ রানের মাথায়। তাহির নাকাশ (৮ম উইকেট, ২ বলে ১ রান) কপিলদেবের বলে সদানন্দ বিশ্বনাথের হাতে ক্যাচ আউট হন। মনজুর ইলাহি মদনলালের বলে তাঁরই হাতে ক্যাচ আউট হন (৯ম উইকেট, ২৪ বলে ৯ রান)। তৌসিফ আহমেদ (৭ বলে শূন্য রান) শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে কপিলদেবের বলে বোল্ড আউট হন।

ঠিক এইভাবেই ১২৫ রানে ইনিংস শেষ করেও ৩৮ রানে ওই ম্যাচ জিতে নেয় ভারত। ইমরান খানের ১০-২-১৪-৬-এর পরে আর কারো “ম্যাচপুরুষ” হওয়ার কথা উঠতেই পারে না বলে মনে করা হলেও শোনা যায় যে গাভাসকারের নাম নিয়েও দীর্ঘ আলোচনা হওয়ার পরেই ইমরান খানের নাম এই পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হয়। ২টি অসাধারণ ক্যাচ সহ মোট ৪টি ক্যাচ নিয়ে সেদিন নিজেকে এই জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন সানি।

ঠাকুরমার ঝুলির শ্রুতিমধুর কিন্তু কাল্পনিক রূপকথার বাইরেও এমন অনেক সত্যিকারের রূপকথা লুকিয়ে আছে আশি-নব্বইর ক্রিকেটে। যার বেশির ভাগের উপরেই এখন আর আলো পড়ে না।