‘ক্যারম বল’-এর কাহিনী ও প্রায়-বিস্মৃত জ্যাক আইভার্সন – প্রথম পর্ব

সূত্রপাত

২০০৮-এর ৬ই জুলাই, করাচিতে এশিয়া কাপের ফাইনালের সন্ধ্যায় মুখোমুখি মাহির ভারত আর মহেলার শ্রীলঙ্কা। টসে হেরে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ঈশান্তের দাপটে চার উইকেটে ৬৬ হয়েও জয়সূর্যর বিধ্বংসী ১২৫, দিলশানের অবস্থাপোযোগী ৫৬ এবং শেষের দিকে কুলসেখারা-ভাসের দৃঢতায় পঞ্চাশ ওভারের এক বল বাকি থাকতে শ্রীলঙ্কার ইনিংস থামল বেশ লড়াকু ২৭৩ রানে। জবাবে গম্ভীরের সঙ্গে নেমে সেহবাগও  ঝড় তোলেন, পঞ্চম ওভারে গৌতি ভাসের বলে ফিরে গেলেও ভিরু চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু দশম থেকে ষোড়শ ওভারের মধ্যেই খেলা ঘুরিয়ে দেন – নাঃ অভিজ্ঞ ভাস বা মুরলি নয় – আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নেহাতই নবাগত এক স্পিনার। দশম, চতুর্দশ ও ষোড়শ ওভারে তিনি ফিরিয়ে দেন ভিরু (সাঙ্গার স্টাম্পিং), যুবি ও রায়না (দুজনেই বোল্ড) এবং রোহিত (এলবিডব্ল্যু) – মাত্র ২১ রানের মধ্যে চারটে উইকেট হারানো ODI-তে এমন আশ্চর্য কিছু নয়, তবে ভারতকে (এবং মাঠের ও TV-র দর্শকদের) স্তম্ভিত করে দেয় যুবরাজের আউটটা [চিত্র-১] – ESPNCricInfo-র Scorecards থেকে একটা লাইন তুলে দিই – “What a little bundle of talent. Pocketful of mystery. Yuvraj is castled. It was flicked on a length on the middle stump line and skidded on straight. Yuvraj played all around it. Gone! And Sri Lanka roar back into the game. Thrilling stuff. Finger-flicking good!” – নবাগত বোলারের নাম অজন্থা মেন্ডিস। হতভম্ব ভাব কাটাতে মরিয়া ধোনি ও উথাপ্পা কিছুটা লড়লেও সাতাশতম ওভারে মুরলির হাতে রব্বি নিধনের পর ‘আবার-সে-এসেছে-ফিরিয়া’ মেন্ডিস বত্রিশতম ওভারে পরপর দু’বলে ‘ছোট’ পাঠান (স্লিপে মহেলার ক্যাচ) ও আরপি (বোল্ড) দুজনকে তুলে নিয়ে ম্যাচ কার্যত শেষ করে দেন – ভারত চল্লিশতম ওভার ১৭৩ রানে বধ হয়ে ১০০ রানে ম্যাচ হারে। মেন্ডিসের বোলিং ৮-১-১৩-৬ – সঙ্গে অবশ্যই ‘ম্যাচ-সেরা’-র পুরস্কার।

চিত্র-১ [যুবরাজের ‘নিধন’ / ‘ঘাতক’ অজন্থা মেন্ডিস]

‘ক্যারম বল’ কি?এই ম্যাচের পর থেকেই ক্রিকেটমহলে চর্চা শুরু ‘যুবরাজঘাতী’ সেই ‘ক্যারম বল’ (Carrom Ball) নিয়ে। বস্তুটা কি? সংক্ষেপে জানাই [সূত্র: Rob Eastaway-র লেখা Portico, UK থেকে ২০১৯ সালে প্রকাশিত “What is a Googly?” বইয়ের পৃষ্ঠা-৬৯]: “… (it) involves flicking the ball with the middle finger as it is released. (It gets its name from the game of carrom, in which disks are similarly flicked.” – আর কথা না বাড়িয়ে একটা ছবি দিই [চিত্র-২], তাহলে ব্যাপারটা তাড়াতাড়ি বোঝা যাবে।

চিত্র-২ [ক্যারম বল: বোলিং গ্রিপ ও বলের গতিপথ (ডান-হাতি ব্যাটারের ক্ষেত্রে)]

‘ক্যারম বল’ আবিষ্কর্তা!

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, অস্ট্রেলীয় সেনাবাহিনীর (Australian Imperial Force, AIF) ল্যান্স সার্জেন্ট পদে নিউ গিনির (বর্তমান রাজধানী) পোর্ট মরেসবিতে কাজ করছিলেন জ্যাক নামে পরিচিত, ২৭-২৮ বছরের এক ভদ্রলোক [জন্ম: ১৯১৫ সালের ২৭শে জুলাই, মেলবোর্ণ] – যিনি বছর-বারো আগে স্কুলজীবনে জোরে বোলিং করতেন, তবে স্কুল ছেড়ে দেওয়ার পর ক্রিকেট প্রায় খেলেননি বললেই চলে। গল্ফটা তিনি ভালই খেলতেন, এমনকি ২১ বছর বয়সে একবার ভিক্টোরিয়া রাজ্যের Maldon Golf Club Championship জিতেছিলেন। বাবার অফিসে চাকরিও করছিলেন, কিন্তু ২৫ বছরে পদার্পণের আগেই সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে উপসাগরীয় (the Gulf) অঞ্চলে চলে যান, পরের দিকে নিউ গিনিতে স্থানান্তরিত হন।

১৯৪৩ (বা ১৯৪৪) সালের কোনও এক সময় তাঁর শক্তিশালী লম্বা আঙ্গুলযুক্ত বিশাল হাতের থাবায় পিংপং বল নিয়ে ঘোরাতে গিয়ে জ্যাক হঠাৎ করে আবিষ্কার করেন যে তাঁর হাতের অস্থিসার লম্বা বুড়ো আঙ্গুল ও বিশাল মধ্যমার সাহায্যে বলটাকে তিনি প্রচুর ঘোরাতে (spin) পারেন। টেনিস বল দিয়ে সেই চেষ্টা করেও একইরকম সাফল্য পেলেন। ক্রিকেট বল দিয়েও অভ্যাস করতে লাগলেন আর উৎসাহিত হয়ে, তাঁর কমবয়সের ক্রিকেটের সাদা পোষাকগুলোকে খানিক অদলবদল করিয়ে, আবার শুরু করলেন ক্রিকেট খেলতে, অবশ্যই স্থানীয় ক্লাবে। ১৯৪৪ সালে জ্যাক বিয়ে করলেন ডরোথি জিন দ্য ট্রেসি নামে এক টাইপিস্টকে – বাড়িতে স্ত্রীকে উইকেটের পেছনে রেখে বোলিং অভ্যাসও নাকি তিনি করতেন। ক্রমে ক্রমে বেশ কয়েক রকম বল করতে পারতেন – অফ-ব্রেক, লেগ-ব্রেক, গুগলি – বোলিং ভঙ্গির কোন পরিবর্তন না করেই।

১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধ শেষে সেনাবাহিনী থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ১৯৪৬-৪৭ মরসুমে, ৩১ বছর বয়সে,  Victoria Cricket Association (VCA) Premiership-এ Brighton দলের হয়ে প্রধানত শনিবারের ম্যাচ খেলা শুরু করলেন, পরে মেলবোর্নে চলে গেলেন। ১৯৪৮-৪৯ মরসুমে সর্বোচ্চ উইকেট, ৬৪টা, গড় ১২.০৬ – সেবারই প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচে অভিষেক হয় এবং তাৎক্ষণিক সাফল্য পান। শেফিল্ড শিল্ডের সাতটা ম্যাচে পান ৪৬টা উইকেট, গড় ১৬.৬০ – ইনিংসে-পাঁচ-উইকেট পান পাঁচবার, যার মধ্যে চারবার ছয় উইকেট। এরপর ১৯৪৯-৫০ মরসুমে বিল ব্রাউনের নেতূত্বে নিউজিল্যান্ড সফরে গিয়ে কামাল করেন – সফরে পান মোট ৭৫টা উইকেট, গড় মোটামুটি সাত – অবিশ্বাস্য! তাঁর জন্য অস্ট্রেলিয়া টেস্ট দলের দরজা এরপরই খুলে যায়।

পরের মরসুমেই, (১৯৫০-৫১), ৩৫ বছর বয়সে, ফ্রেডি ব্রাউনের সফরকারী ইংল্যান্ড দলের বিরুদ্ধে দেশের হয়ে টেস্ট-ম্যচ খেলতে নির্বাচিত হলেন। ঐ অ্যাশেজ সিরিজে এই দীর্ঘকায় ব্যক্তিটির বোলিং খেলতে গিয়ে সফরকারী ব্যাটাররা এমন বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন যে সিরিজে তিনি মোট ২১টা উইকেট নেন, গড় ১৫.২৩ – সিডনির তৃতীয় টেস্টে দ্বিতীয় ইনিংসে ২৭ রানে ৬ উইকেট নেন, কিন্তু পরের টেস্টে অ্যডিলেডে বলের ওপর পা পড়ে গিয়ে গোড়ালিতে চোট পান। তারপরের দু’মরশুমে মাত্র একটি করে প্রথম-শ্রেণীর খেলা খেলে ক্রিকেট থেকে অবসর নেন ১৯৫৩-৫৪ মরসুমের শেষে।

জন ব্রায়ান ‘জ্যাক’ আইভার্সন [মৃত্যু: ১৯৭৩ সালের ২৪শে অক্টোবর, মেলবোর্ণ] ছিলেন একজন অ-সাধারণ বোলার যিনি তাঁর অতিসংক্ষিপ্ত পাঁচ বছরব্যাপী ক্রিকেট-জীবনে পাঁচটা টেস্ট, ৩৪টা প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচ খেলেই একটা হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন – সৌজন্যে তাঁর আঙ্গুলের সেই অদ্ভুত কায়দা।

চিত্র-৩ [ক্যারম বল: আবিষ্কর্তা জ্যাক আইভার্সন]

[কৃতজ্ঞতাস্বীকার এবং তথ্যনির্দেশ]:

  1. What is a Googly? – Rob Eastaway; edition 2019
  2. Twirlymen – Amol Rajan; edition 2013
  3. Mystery Spinner – Gideon Haigh; edition 2000
  4. CircleOfCricket.com
  5. CricTracker.com
  6. ESPNCricInfo,com
  7. GamePlanToday.com
  8. IndiaToday.in
  9. TimesNowNews.com
  10. Wikipedia.org

[ছবির কৃতজ্ঞতাস্বীকার]:

  • ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত – চিত্র ১,
  • Twirlymen – চিত্র ২
  • Mystery Spinner – চিত্র ৩