ইংল্যান্ড বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট -সিরিজের এতদিন নাম ছিল উইজডেন ট্রফি। এবার নতুন নামকরণ হয়েছে রিচার্ডস-বোথাম ট্রফি। কিন্তু কাহিনী খুব বেশি বদলায়নি। অন্তত ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে তো নয়ই। ইংল্যান্ড শেষ বার যখন ক্যারিবিয়ানে টেস্ট সিরিজ জিতেছিল, ইংল্যান্ডের অধিনায়ক তখন মাইকেল ভন। ক্রিস গেল টেস্টে নিয়মিত। নাসির হুসেন তখনও ধারাভাষ্যকার নন, রীতিমতো খেলোয়াড়। এরপর থেকে পরবর্তী ১৮ বছরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের টেস্ট গ্রাফ ক্রমাগত নিম্নগামী। আর ইংল্যান্ডের গ্রাফ খানিকটা শেয়ার বাজারের মতো। কখনও আকাশছোঁয়া, আবার কখনও পাতালগামী। কিন্তু ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে টেস্ট সিরিজ জিতে ফেরার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেছে ইংরেজদের। এবারেও তার ব্যতিক্রম হবার কারণ নেই।
জঘন্য ভাবে অ্যাশেজ সিরিজ জলাঞ্জলি দেবার পর, এবার এমনিতেই জো রুটের দলের ছেলেদের কাছে ক্যারিবিয়ান সফর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুরো ঢেলে সাজানো দল নিয়ে রুট এসছিলেন ক্যারিবিয়ানে। কিন্তু এবারেও অশ্রু সজল নয়নে ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তাদের। এই লেখার সময় অব্দি সিরিজের তৃতীয় টেস্টের তৃতীয় দিনে ইংল্যান্ড ১০৩ রানে ৮ উইকেট। বকলমে ১০ রানে ৮ উইকেট। যদি জ্যাক লিচ, ক্রিস ওকস ও শাকিব মেহমুদের ওপর উইলিয়াম গ্রেসের আত্মা ভর করার মতো আজগুবি কিছু না ঘটে, তাহলে এই টেস্ট ও সিরিজ ব্রেথওয়েটের দলের ছেলেরাই জিতছে। অথচ রুটের ছেলেরা চেষ্টা তো কম করেনি। আর শুধু তাঁরাই কেন, সফররত সমর্থকরা? কেনসিংটন ওভালের গ্যালারিতে পুনরায় ইংরেজ কলোনি স্থাপন করে ফেলেছিলো। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজ অটল। তাঁদের অধিনায়ক ব্রেথওয়েটের মতোই।
ব্রিজটাউনের দ্বিতীয় টেস্টে জ্যাক লিচ অনবরত বল করে গেছেন। ওই ম্যাচের পর লিচের কাঁধ থেকে হাত খুলে যাবার কথা। ৯৪.৫ ওভার তিনি বল করেছেন ওই টেস্টে। যার অধিকাংশ ব্রেথওয়েটকে করা। আজকাল ইউটিউবে একাগ্রতা বাড়ানোর নানান রকম ভিডিও পাওয়া যায়। ক্রিকেট-প্রেমীর কাছে সেসব নিষ্প্রয়োজন। একাগ্রতা কাকে বলে দেখার জন্যে ব্রেথওয়েটের বার্বাডোজ ইনিংস দু’টি চালিয়ে দিলেই হবে। বেন স্টোকসের মারকাটারি সেঞ্চুরি, রুটের দেড়শো। ব্রেথওয়েটের সাধকসম ইনিংস সব কীর্তিকে একাগ্রতার পর্দা দিয়ে ঢেকে দেবার জন্যে যথেষ্ট। এ তো গেলো প্রথম ইনিংসে, যখন তিনি পাশে পেয়েছিলেন ব্ল্যাকউডকে। আরেকজন খেলোয়াড় যিনি ইংল্যান্ডকে দেখলেই জেগে ওঠেন। ক্ষয়ে যাওয়া পিচে ম্যাচ বাঁচাতে হবে এই অবস্থায় এক আনকোরা কিপার জোশ ডা সিলভা ছাড়া কাউকেই তো পাননি। তাও একটি মুহূর্তের জন্যেও মনে হয়নি, তিনি আউট হয়ে যেতে পারেন। তবে শুধু ব্রেথওয়েট হলে তো রক্ষা। দ্বিতীয় টেস্টে যদি ব্রেথওয়েট হয়ে থাকেন, প্রথম টেস্টে তবে বোনার। তাঁর সেঞ্চুরিটি আরো বেশি প্রশংসার দাবি রাখে কারণ তিনি তো বর্তমান প্রজন্মের খেলোয়াড়। বোনার ও ব্রেথওয়েট তাঁদের একাগ্র সেঞ্চুরি দিয়ে প্রথম দুই টেস্ট বাঁচিয়ে দিলেন। আর তৃতীয় টেস্টে জশুয়া ডা সিলভার শ্রমিক সেঞ্চুরি ৫০-৫০ টেস্ট ম্যাচকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে ৯০-১০ করে দিলো। অবশ্য ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে লিচ ও মাহমুদ শেষ উইকেটে ৯০ রান না জুড়লে ৫০-৫০ অব্দি পৌঁছনোর গল্পই ছিল না।
ট্রফির নামে তিনি, ভিভ রিচার্ডস থাকতে পারেন। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এই সিরিজ ‘প্রায়’ জিতে নিলো তাঁর বিপরীতধর্মী ক্রিকেট খেলে। সত্তর আর আশির দশক আর নেই যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটার ও বোলাররা ইংল্যান্ডকে খাদ্য করবে। এখন এই মধ্যবিত্ত দলকে খুঁটে খুঁটে খেতে হবে। এবং সেটা ব্রেথওয়েটের দলের ছেলেরা দারুন ভাবে করে দেখাচ্ছে। এই সিরিজ রুটের কপালে চিন্তার প্রলেপ আরও দু এক পোঁচ বাড়িয়ে দেবে। টপ-অর্ডার এখনও বড়বাজারের ভাঙা বাড়িগুলোর মতো নড়বড়ে। একটু টোকা দিলেই ভেঙে যায়। ক্রলি যদিও বা মাঝে মধ্যে চেষ্টা করেন, সেই ‘মাঝে মধ্যে’ টা আসে অনন্তকাল পরে পরে। ব্যাটিং বলতে রুট, স্টোকস ও খানিক বেয়ারস্টো। কৌলিন্য ও স্কিলে এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোলিং লাইন আপ নিতান্তই নিম্নমধ্যবিত্ত। হোল্ডার ও রোচ ছাড়া কেই বা রয়েছেন? তাতেও ইংল্যান্ডের এই অবস্থা। অ্যাশেজের ভরাডুবি তাই আর এখন বার্মি আর্মির হাহাকার করার কারণ হতে পারে না। বোলিংটাও অনভিজ্ঞ। তবে অ্যান্ডারসন ও ব্রডের বাইরে তাকিয়ে রুট যে নতুন প্রজন্ম তৈরিতে একটু হলেও নজর দিয়েছেন এই সিরিজে, তা একদিকে খারাপ নয়। তবে এই সিরিজে হারলে আবার অ্যান্ডারসন ও ব্রডের দিকেই না রুট-কে তাকাতে হয়। সে তাকাবেন নাহয়। ইংল্যান্ডের টিভি কোম্পানিও তো নতুন ছেড়ে পুরোনো ধারাভাষ্যকার ডেভিড গাওয়ারের দিকেই তাকিয়েছে। পুরোনো চাল মাঝে মধ্যে ভাতে বাড়ে কিনা!