এই প্রতিবেদন লেখার সময়ে চলতি বিশ্বকাপে দুটো গ্ৰুপেরই সমস্ত দল নির্ধারিত পাঁচটার মধ্যে চারটে করে ম্যাচ খেলার পরেও কোন দল সেমিফাইনাল নিশ্চিত করতে পারেনি। আপাতভাবে বিশ্বকাপের মতো বড় প্ৰতিযোগিতার জন্য যথেষ্ট ভাল বিজ্ঞাপন।কিন্তু এত উত্তেজক এবং উপভোগ্য গ্ৰুপ পর্যায়ের পরও ফলাফল কিন্তু প্রায় সেই থোড় বড়ি খাড়া। এটুকু প্রায় নিশ্চিত যে প্ৰথম গ্ৰুপ থেকে পরের পর্যায় যাচ্ছে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের মধ্যে দুটো টিম এবং অন্য গ্ৰুপ থেকে বড় কোন অঘটন না ঘটলে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভারত, হ্যাঁ সেই তথাকথিত বড় দল গুলোই বাজিমাত করলো। জিম্বাবোয়ে-পাকিস্তান ম্যাচ বাদ দিলে ছোট দলগুলোর প্রতিটা ম্যাচেই প্রায় প্রত্যাশিত ফলাফলই হয়েছে, গ্ৰুপ পর্যায়ে বাকি যেটুকু উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, সেটার জন্য দায়ী বৃষ্টি।
পরিসংখ্যান বলছে ২০১৭র বাংলাদেশকে ব্যতিক্রম ধরলে, ২০০৩ বিশ্বকাপের পর কোন তথাকথিত ছোট দল আইসিসি টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে ওঠেনি, অথচ এই সময়কালে আইসিসি ১৯টা প্রতিযোগিতা আয়োজন করেছে। আরও অবাক করার মতো বিষয় ২০১৩র পর আইসিসি আয়োজিত ৮টা প্রতিযোগিতার ৩২ টি সেমিফাইনালিস্ট এর মধ্যে ২৯ টি জায়গা নিয়েছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভারত-পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকা! অর্থাৎ বৃত্তটা ক্রমশ আরও ছোট হয়েছে। ক্রিকেটের বিশ্বায়ন কি তবে শুধুমাত্র অংশগ্রহণ-এই সীমাবদ্ধ? ফুটবলে যদি তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, ঘানা, ক্রোয়েশিয়া হতে পারে ক্রিকেটে হয় বা কেন?
২০০৫ সালে ভারতের করা জিম্বাবোয়ে সফরের কথা মনে আছে? হ্যাঁ, সেই সফর যেখান থেকে সৌরভ বনাম চ্যাপেল অধ্যায়ের শুরু। খেরোর খাতা বলছে আজ পর্যন্ত ওটাই ভারতীয় টেস্ট দলের করা শেষ জিম্বাবোয়ে সফর। এটা ঠিক যে ঐ সফরের পরে ক্রিকেট বোর্ড এবং রাজনৈতিক ঝামেলায় জিম্বাবোয়ে ২০১১ পর্যন্ত টেস্ট খেলেনি কিন্তু তারপরও তো এগারো বছর কেটে গেছে! ভারত কেন জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে একটাও টেস্ট খেলেনি? আজ গ্ৰুপ পর্যায়ের শেষ ম্যাচে মরণ বাঁচন পরিস্থিতিতে অস্ট্রেলিয়া খেলতে নামছে আফগানদের বিরুদ্ধে। প্রশ্ন উঠছেই, আফগানিস্তানে বর্তমান প্রশাসকদের কাছ থেকে মহিলাদের ক্রিকেট খেলার উপর নিষেধাজ্ঞা কি উঠে গেছে? যে অজুহাতে অস্ট্রেলিয়া টেস্ট খেলতে অস্বীকার করেছিল আফগানদের সঙ্গে? সেটাই যদি কারণ হয়, এই গ্ৰুপ ম্যাচও তো না খেলা উচিত, কিন্তু এমন পরিস্থিতি যে এই ম্যাচ না খেললে নিজেরাই নিজেদের প্রতিযোগিতার বাইরে করে দেবে। আসলে বিভিন্ন আছিলায় সুযোগ পেলেই বড় দলগুলো এখন পূর্নশক্তির দল নিয়ে ছোট দলগুলোর সঙ্গে সিরিজ খেলতে অস্বীকার করছে, এতে করে প্রভূত ক্ষতি হচ্ছে ছোট দলগুলোর।
১৯৯৬ বিশ্বকাপ শুরুর প্রাক মুহূর্ত অবধি শ্রীলঙ্কাকেও তথাকথিত ছোট বা দুর্বল দল হিসেবে ভাবা হতো। কিন্তু ১৯৮২ সালে টেস্ট খেলার যোগ্যতা পাওয়ার পর থেকে কোন দল কখনোই কম শক্তির দল নিয়ে সেখানে সফর করতে যায়নি। একই কথা প্রযোজ্য জিম্বাবোয়ের ক্ষেত্রেও। ফলে দ্বিপাক্ষিক বা ত্রিদেশীয় সিরিজ গুলোতেও মুরলি, জয়সূর্য, ফ্লাওয়ার-রা শচীন,ওয়ার্ন, আক্রম-দের খেলার সুযোগ পেতেন, সঙ্গে ছিল কাউন্টি ক্রিকেট। অথচ আজকের পরিস্থিতি অনুযায়ী এই যে জসপ্রীত বুমরা বিশ্বকাপে আসতে পারলেন না, ফলে সিকান্দার রাজার পুরো কেরিয়ার হয়তো শেষ হয়ে যাবে কিন্তু এযুগের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলারকে খেলার সুযোগ কোনদিন হবে না। ফলে এই দলগুলো বিশ্বকাপের মতো বড় প্রতিযোগিতায় যখন নামছে, অনেকটা পুকুর থেকে সাগরে এসে পড়ার মতো অবস্থা হচ্ছে। যে দু একটা ম্যাচ জিতছে, সেগুলোকে অঘটনের তকমা দেওয়া হচ্ছে, বড় দলগুলো অভিজ্ঞতা দিয়ে ম্যাচ বের করে নিয়ে চলে যাচ্ছে। আজ জিম্বাবোয়ে পাকিস্তানকে হারালে সেটা অঘটন কিন্তু ১৯৯৯ সালে যখন ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে সুপার সিক্সে উঠলো, সেটাতে অনেকেই অবাক হলেও অঘটন বলা হয়নি কারণ সেই দলটা শক্তিশালী ছিল, মাঝেমধ্যেই এইসব দলের বিরুদ্ধে জিততো। এরা দীর্ঘদিন ধরে বড় দলগুলির সঙ্গে সিরিজ খেলে খেলে নিজেদের পরিণত করেছিল, প্রস্তুত করেছিল।
১৯৯৮ সালে ভারতে একটা ত্রিদেশীয় সিরিজ হয়েছিল যার অন্য দুটো দল ছিল কেনিয়া ও বাংলাদেশ এবং শচীন সৌরভরা সেই সিরিজ খেলেছিলেন। কোহলি-রোহিতরা ভাবতে পারবেন? ওঁদের কথা ছেড়ে দিন, সমর্থকরাও আজকের দিনে ভাবতে পারবেন যে সদ্য শ্রীলঙ্কাকে হারানো নামিবিয়ার বিরুদ্ধে একটা তিন ম্যাচের সিরিজ হবে আর সেখানে খেলবেন কোহলি বুমরা? পারবেন না, কারণ সমর্থকদের মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘ওয়ার্কলোড ম্যানেজমেন্ট’ নামক মন্ত্র, যে মন্ত্র দুস্টু লোকের মতো ভ্যানিশ হয়ে যায় ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগ আসলেই। আর তাই যদি হয় অর্থাৎ তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নেওয়া হয় যে ওয়ার্কলোড ম্যানেজমেন্টের জন্য বড় এবং ব্যস্ত খেলোয়াড়দের সব সফর করা সম্ভব নয় তবে আবশ্যিক করা হোক যে বিশ্বের সমস্ত ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগে প্রতিটা দলকে প্রতিটা ম্যাচে অন্তত একজন বিদেশী খেলাতে হবে যিনি এসোসিয়েট দেশ বা আইসিসি র্যাঙ্কিংয়ে দশের পরে থাকা দলের খেলোয়াড়। তা না হলে টেম্পারমেন্টের অভাবে বারবার বড় আসরে পিছিয়ে পড়বে তথাকথিত ছোট দলগুলো।
টাকা! টাকা! তোমার বোধ নাই আইসিসি?