‘ক্যারম বল’ চর্চা ও উত্তরাধিকার
কেউ কেউ যদিও বলে থাকেন যে ১৯৪০-এর দশকেও নাকি এইরকম বল করা প্রচলিত ছিল, কিন্তু বেশির ভাগ ক্রিকেট বিশেষজ্ঞের মতে আইভার্সনই প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এটা চালু করেন। তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে ভারতীয় বংশোদ্ভুত বিখ্যাত ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান স্পিনার সনি রামাধীন [পঞ্চাশের দশকে দশবছরেরও বেশি দীর্ঘ টেস্ট-জীবনে ৪৩ ম্যাচে এঁর উইকেট-সংখ্যা ১৫৮] তাঁর অফ-ব্রেক বল করতেন বলের সেলাই বরাবর মধ্যমা রেখে – প্রথাগত অফ-স্পিন বোলিংয়ে মধ্যমাটি থাকে সেলাইয়ের আড়াআড়ি [চিত্র-৪] – আর মাঝেমধ্যেই ব্যাটারদের বোকা বানাতেন বোলিং ভঙ্গির কোন পরিবর্তন না করেই।
জন গ্লিসন [চিত্র-৫] – আইভার্সনের অবসরের বছর বারো পরে, ১৯৬৬-৬৭ মরসুমে অস্ট্রেলিয়াতে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে ইনি এটা আবার চালু করেন। তাঁর এই রহস্য তাঁকে টেস্ট-জীবনের প্রথমদিকে, ১৯৬৭-৬৮ ও ১৯৬৮-৬৯ মরসুমে বেশ কিছুটা সাফল্য এনে দিলেও ১৯৬৯-৭০ মরসুমে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে প্রখ্যাত ওপেনার ব্যারি রিচার্ডস চটপট রহস্যভেদ করে ফেলেন। এরপর গ্লিসন আর মাত্র দু’বছর টেস্ট-ক্রিকেটে ছিলেন। পাঁচ বছরের টেস্ট-জীবনে তিনি ২৯ ম্যাচে ৯৩টা উইকেট দখল করেন। ১৯৬৯-৭০ বিল লরির অস্ট্রেলিয়া দলের সঙ্গে ভারতে খেলে-যাওয়া গ্লিসনের নিজের মতে অল্পবয়সে বাবার দুগ্ধ-খামারে রোজ নিয়মিত গরু দোয়ানোর ফলেই নাকি তাঁর আঙ্গুলের শক্তি বেড়ে ওঠে, যা এই জাতীয় বল করতে একান্ত জরুরি।
অজন্থা মেন্ডিস – ইনি তো লেখার শুরুতেই এসেছেন। মনে করিয়ে দিই যে এক শতকেরও বেশি সময় ধরে – ১৯৩২ সালে ভারতের টেস্ট-অভিষেকেরও আরো চার / পাঁচ দশক আগে থেকেই – বহু স্পিনের ওস্তাদের জন্মদাতা এই ভারতীয় উপ-মহাদেশে কিন্তু মেন্ডিসই প্রথম এই ধরণের বল করা শুরু করেন। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ আশ্চর্যজনক বলে মনে হয়। আর আইভার্সনের মতোই ইনিও কিন্তু আদতে সেনাবাহিনীর লোক – শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনীর গানার হয়ে ২০০৪-এ কর্মজীবন শুরু করে, সার্জেন্ট ছুঁয়ে দ্বিতীয় লেফটেন্যান্ট হয়ে ওঠেন ২০০৮-এর এশিয়া কাপ জয়ের পরেই।
রবিচন্দ্রন অশ্বিন – বর্তমানে পৃথিবীর সেরা স্পিনারের কথা অনুযায়ী তিনি এটি শিখেছেন – তখন তিনি শহরের টেনিস বলের ক্রিকেটের নামী ব্যাটার – SK নামে স্বল্প-পরিচিত এক সহ-খেলোয়াড়ের কাছ থেকে দিন দশ-পনেরো তালিম নিয়ে। SK-কে তিনি নাকি পরে আর যোগাযোগ করতে পারেননি। অশ্বিনের কথায়, SK-র এই বোলিং “… made me look like an absolute idiot (as a batter).” এটিকে অশ্বিন ‘Sodukku Ball’ বলে থাকেন, কারণ তাঁর মাতৃভাষা তামিল অনুযায়ী ‘sodukku’ শব্দের অর্থ ‘তুড়ি দেওয়া’ (snapping of fingers). টেনিস বল শুনে আবার কি আইভার্সনের কথা মনে হচ্ছে?
সুনীল নারিন – IPL-এর নামীদামী তারকা ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই বোলার মাঝেমধ্যেই এমন বল দিয়ে ব্যাটারদের ধাঁধায় ফেলেন – পিচে পড়ে দ্রুত আসা (zip off the pitch) এরকম বল আগে থেকে বুঝে ফেলা খুব কঠিন। ইনি ক্যারম বল দু’দিকেই – লেগ থেকে অফ ও অফ থেকে লেগ – ঘোরাতে পারেন।
মিচেল স্যান্টনার – নিউজিল্যান্ডের এই স্পিনারটির নাম সবশেষে করি কারণ – (১) আলোচিত বাকি ক্রিকেটারদের তুলনায় তিনি নতুন, এবং (২) যিনি, ২০১৮-র ১৬ই জানুয়ারি হ্যামিল্টনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক ODI-তে, বাঁ-হাতি স্পিন-বোলার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট প্রথমবার এমন বল দিয়ে ফকর জামানকে (বোল্ড) আউট করেছেন, যেমনটা মেন্ডিস করেছিলেন করাচিতে, প্রায় এক দশক আগে। ইনি ২০১৬ সালে ভারত সফরে এসে অশ্বিনকে এমন বল করতে দেখে উৎসাহিত হয়ে চেষ্টা করতে শুরু করেন – তাঁর Carrom Ball-এর এই বাঁ-হাতি অবতারকে নাম দিয়েছেন ‘Claw Ball’, এবং সেটিকে আরো নিখুঁত করার অভ্যাসে মগ্ন।
অন্তহীন অন্তঃসলিলা সেই ধারা পঞ্চাশের দশকের আইভার্সন থেকে ষাটের দশকের গ্লিসন, (হয়তো) রামাধীন থেকে অর্ধ শতাব্দী পরে নারিন, 2000s-এর মেন্ডিস থেকে (via-SK) 2010s-এর অশ্বিন, আর তারপর অশ্বিনের ডান হাত থেকে 2020-ছোঁয়া স্যান্টনারের বাঁ-হাতে – অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে শ্রীলঙ্কা-ভারত হয়ে সুদূর নিউজিল্যান্ড – সত্তর বছরের এই আশ্চর্য ঐতিহ্য ধীরে ধীরে বয়ে চলেছে এক ফল্গু নদীর মতো, ক্রিকেট-দুনিয়াময়।